গদ্যঃ সুপর্ণা দেব


ঠোঙা ভরা গল্প ভাজা


বাড়িতে নতুন বউ এসেছে ভারি ভুলো মন ঠাকুর ঘরে আঁশ বটি রেখে আসছে , রান্নাঘরে চন্দন বাটাশ্বশুরকে চানের সময় তেলের বাটির জায়গায় এগিয়ে দিচ্ছে নস্যির ডিবেআর শাশুড়িকে ? সে কথায় আর নাই বা গেলামমোটের ওপর সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার তার ওপর জলে জঙ্গলের এই দেশ মানে দ্যাশ জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ এই নিয়েই ঘর গেরস্থালি এক গাদা আত্মীয় স্বজন , কাজের লোক, মুনিষ সব মিলিয়ে দিনে রাতে টা পাত পড়ে তার হিশেব রাখা দায় কেউ একজন যদি ঘরে না থাকে তাকে কেউ সারা দিনে মনে করবে এমন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না এমন সংসার সামাল দিতে হিমশিম আমাদের ভুলোমনের বউ রাতে কুপি বাতির আলোয় পুকুর ঘাটে মুখ ধুতে ,বাসন মাজতে এসে তার আচমকা একটা কথা মনে পড়ে গেল শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বউ বললভাল কথা মনে হল আঁচাতে আঁচাতে/ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেছে নাচাতে নাচাতে মানেটা হল সক্কালবেলা নদীতে নাইতে যাবার সময় বউটির ননদকে কুমীরে টেনে নিয়ে গেছে বেচারার কী দোষ, ঠিক সময় ঠিক কথা মনে পড়লে তো ?

 --------এবার বড় কোবরেজ মশাই শেষ অবধি বলেই ফেললেন, রোগীকে টেংরির জুশ খাওয়াতেই হবে তা নাহলে গায়ে বল আসবে নাকোবরেজ মশাইএর নাতি কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে পড়ে কিনা
 বোষটোমের বাড়িমাছ মাংস ঢোকেনাকর্তা মা বাধ্য হয়ে টেংরি রেঁধেছেন তার আদরের মনুর জন্য
মনুকে এক চামচ করে জুশ খাওয়ান আর জিগ্যেস করেন , “ মনু , বল পাতিসো ?”
আরো এক চামচ , “ মনু বল পাতিসো?”
----কাদের ফরাসি বলে বলত? ফ্রেঞ্চ দূর দূর জানিস নাযারা ফর ফর করে রাশি রাশি কথা বলে

এইসব ননসেন্স গল্পের ঝুলি ছিল আমার ছোট পিসির কাছে ঢাকাই কুট্টীর যত গল্প ওই ওনার কাছেই শোনা
ছোটপিসি আমার দেখা একটা অদ্ভুত আশ্চর্য চরিত্রইনি বাংলা আর সংস্কৃত দুটো বিষয়ে এম করেছিলেন স্কুলে পড়াতেন এবং হেড মিস্ট্রেস হয়েছিলেন।  আজকের যুগেও তাদের বাড়িতে তিতো দিয়ে শুরু মিষ্টি দিয়ে শেষ এই কোর্সে প্রতিদিনের খাওয়া চলত স্কুল করে, খাতা দেখে, ছাত্রী ঠেঙিয়ে বাজার করে রান্না করে দুটো অসম্ভব অবাধ্য ডানপিটে ছেলে এবং সামন্ততান্ত্রিক স্বামী নিয়ে আপাত দৃষ্টিতে খুবই ঘোরতর সংসারী পিসি মনের মধ্যে জন বাস করত বা পিসি চিন্তা ভাবনার কোন স্তরে থাকতেন আমি তার হদিশ পাইনিএকদিন রেলস্টেশনে পিসির ছেলে পার্থ দেখল পিসি দাঁড়িয়ে আছে পার্থ ডাকল, মা, ওমা ? পিসি শুনতে পেলনা পার্থ একটু এগিয়ে গিয়ে পিসির কনুই ধরে আবার ডাকল মা , ওমা ? পিসি এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বলল,” কে আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না তখন থেকে মা মা করছেন?”
পার্থ প্রায় ভিরমি খেয়ে পড়ে যায় কিন্তু এটাও বুঝতে পারে যে তার কৌতুকপ্রিয় মা কিন্তু এখন মজা  করছে নাপিসি চিনতেই পারছে না তার ছেলেকে পার্থ আমাকে বলেছিল লোকের মারধোর খাবার ভয়ে ওখান থেকে সরে এলামজীবনে এত বেইজ্জতি আর কখনো হয় নি
আবার এই পিসি একদিন আমাকে বলেছিল ওই ছেলেটাকে দেখওই যে রাস্তার ওধারেখুব চেনা চেনা লাগছেতীর্থর মত দেখতে না?
অসহায় ভাবে অবাক হয়ে পিসির দিকে তাকিয়েই ছিলামবলতে পারিনি ওটা তো তীর্থই!

 ছেলের বিয়ের সম্মন্ধ পাকা করতে যাবার দিন পিসি বেশ তসরের শাড়ি মটকা সিল্কের শাল বটুয়া দিয়ে সেজে গুজে গেলেনকিন্তু এবারেও পিসির কর্মোদ্যোগে জল ঢেলে দিল একজোড়া হাওয়াই চটি বা কখনো দুপায়ে দুরকম চটিলোকজন হেসে গড়িয়ে পড়লকোন জগতে থাক তুমি মঞ্জুদি? ইস্কুলের মেয়েরা কথা শোনে তোমার? পিসি সারা জীবন অসংখ্য বার চেষ্টা করেছেন সবাইকে বোঝাতে যে তিনি কী কড়া দিদিমণি ছিলেন! কেউ বিশ্বাস করত না

পিসি আমাদের কলকাতায় বাড়িতে ছুটিছাটায় আসতকিন্তু কোনবার একবারে আমাদের বাড়িতে আসতে পারত নারাস্তা ভুলে যেতপ্রত্যেকবারনিয়ম করেআমাদের ঠিকানা সোজা সাপটাই ছিলঅথচ কোন একটা পয়েন্টে এসে কিনু গোয়ালার গলির মত পিসির কাছে সব কিছু গুলিয়ে যেতপিসি মফস্বলের হেড দিদিমণি থেকে মোগল রাজকুমারী গুলবদন বেগম হয়ে যেত

আমার বড় পিশেমশাই খবরের কাগজ পড়তেন, সঙ্গে থাকত একটা লাল আর নীল কালির পেনতিনি প্রত্যেকটা লাইনের তলায় দাগ দিয়ে কাগজ পড়তেন , নীল কালি দিয়েআর যে সব ব্যাপারে তার মন্তব্য থাকত সেখানে দিতেন লাল কালির দাগকখনো প্রশ্নবোধক, বিস্ময় সূচক চিহ্নকাগজগুলো প্রায় আর্কাইভের মত করে তারিখ মাস অনুযায়ী একট তাকের ওপর পাট পাট করে সাজানো থাকতপিশেমশাই কাগজের ঠোঙা পলিথিনের ব্যাগ সব পাটপাট করে ভাঁজ করে রাখতেনআজকের ট্যাঁসেরা বলবে তাও জান না ? ওটা তো OCD। কাগজগুলো নিশ্চয় একটা সময়ে বিক্রি হতমনে হয় সেটা উনি নিজেই করতেনরেফারেন্স হিশেবে কোনো কোনো কাগজ ওনার দরকার পড়তকোন নেতা দুদিন আগেই হয়ত অন্য কথা বলেছিলেন , সেটা যাচাই করা দরকারঅর্থ নীতির নানান সূচক কয়েকদিন ধরে কী চলছে এই সব নানান তথ্য তিনি নিজেই একা একা প্যানেল ডিসকাশনের মত করতেন এতো সব রকমারি খবরের চ্যানেল ছিল না তো তাই নিজেদের মাথার ধার টা নিজেরাই বাড়াতেন

একবার হল কি পিশেমশাই খেয়াল করলেন ১৭ মার্চের কাগজ খানার কয়েকটা পাতা নেইএখানে বলে রাখা ভাল ইনি আমার বাবার থেকে অনেকটা বড় ছিলেন এবং ভাষায় স্বভাবে কট্টর বরিশালিয়াখানিকটা দাদু ঠাকুরদা বলেই মনে হত ওনাকেপিশেমশাই হুঙ্কার ছাড়লেন,” কাগস খান গেল কই?” বাড়িতে কিছুক্ষণের পিনপতন নৈঃশব্দকোন উত্তর না পেয়ে আবার হুঙ্কার, কি হইল? কাগস খান কি উইড়্যা গেল? এবার ছেলের বউ মিনমিন বলতে থাকল কী জানি , শিখা বোধহয় কয়েকটা শাড়ি মুড়ে নেবার জন্য...

ক্যান বাড়িতে কেউ কিসু কয় নাই?”

শেষ পর্যন্ত পিশেমশাই ফরমান জারি করেছিলেন যে ওই কয়েকটা পাতা মেয়ের বন্ধু শিখার বাড়ি থেকে যে ভাবে হোক নিয়ে আসতে হবেএরপর তাদের বন্ধুত্ব টিকে ছিল কিনা জানা নেই আমার
তবে একটা কথাপিশেমশাই আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন তার সংগ্রহে ছিল প্রচুর বইরচনাবলীর পর রচনাবলী তাদের মধ্যে গোছা গোছা নিম পাতা দেওয়া থাকত তিনি শুধুমাত্র আমাকে বই পড়তে দিতেন আর কাউ কে না নিজের ছেলে মেয়েকেও নাদুমড়ে মুচড়ে বই পড়া, শুয়ে শুয়ে বই পড়া এসব উনি বরদাস্ত করতেন না শুধু তাই নয় ,আমাকে তিনি প্রায় অন্ধের মত স্নেহ করতেনতার জন্য আমার গোবেচারা স্বভাবটাই যে একমাত্র দায়ী সেটা আমি এখন বেশ বুঝতে পারি পিশেমশাই ছোটপিসির ছেলে পার্থকে একদম দেখতে পারতেন নাপার্থ ভয়ঙ্কর রকমের দুষ্টু ছেলেএই নিয়ে ছোট পিসির মনে কত ক্ষোভ ছিল।  

আমার পরিষ্কার মনে আছে একদিন আমি বসে বসে ছবি আঁকছিরঙ তুলি দিয়েপার্থ আমার হাত টা নাড়িয়ে দিচ্ছে , নয়ত রঙের প্লেট টা টেনে নিচ্ছে , নয়ত জল ছিটিয়ে দিচ্ছেআর আমি অসহায়ের মত অত্যাচারিত হচ্ছি কারণ ওর সঙ্গে দস্যিপনায় আমি পেরে উঠব নাআমরা পিঠোপিঠি ভাইবোন

এমন সময় রঙ্গমঞ্চে পিশেমশাইএর প্রবেশ।  এসেই পার্থর দিকে তাকিয়ে গলার স্বর উঁচু নিচু করে এক খানা নাটকীয় সংলাপ দিলেন কী করত্যাসে কওছবি আঁক তাসেকী করত্যাসে? সৃষ্টি তুমি কী করত্যাস? ছবিটা নষ্ট করত্যাসকী করত্যাস? ধ্বংস

সেই অবোধ বালকটিকে সৃষ্টি লয়ের জটিল তত্ত্বের হাত থেকে ছোটপিসি উদ্ধার করে নিয়ে যান, “জামাইবাবু আমার ছেলেটাকে একদম দেখতে পারে না
কথাটা পার্থও জানতসেই বালক মনের সুপ্ত প্রতিহিংসা নেবার সুযোগ এল কিশোর বয়সে আমরা বড়পিসির বাড়ি গেছিলাম শীতের একটা পড়ন্ত দুপুর মা আর ছোটপিসি দু জনে কলেজ জীবনের সখী ছিলতারা সেদিন রাশি রাশি হোম ওয়ার্ক দিয়ে আমাকে আর পার্থকে রেখে কোথাও গেছিল পার্থ ষড়যন্ত্রের প্ল্যান টা ছিল আমরা একটা কোন প্রশ্ন উত্তর নিয়ে খুব ঝগড়া করব যে কার উত্তরটা ঠিক চেঁচামেচি শুনে পিশেমশাই আসবেনতারপর প্ল্যান মাফিক কাজ
এমন সাবজেক্ট নিতে হবে যেটা পিশেমশাই ভাল জানেন নাঅঙ্ক, ইংরেজি , ইতিহাস এসব নিলে হবে নাঅতএব সংস্কৃত বেছে নেওয়া হল

যথারীতি পিশেমশাই এসেই জানতে চাইলেন এত সোরগোল কেনপার্থ ভালমানুষের মত মুখ করে বলল, না মানে কার উত্তরটা ঠিক এটা বুঝতে পারছি না তো , তাই

তা প্রশ্নটা কী?
শুনেই উনি বুঝলেন এটা উনি একেবারেই জানেন নাপিশেমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেনতুমি কী কইত্যাস?”
আমি আমার উত্তরটা বললামএকটুও সময় নষ্ট  না করে পিশেমশাইএর ঝটিতি জবাবঅর টাই ঠিকএত কথা কওনের কি আসে?’’

আবার একপ্রস্থ নাটকঅনেক বইটই ঘেঁটে পার্থ জানালনা , দেখছি আমারটাই ঠিক, এই যে এইখানে লেখা আছে
এবারেও একটুও সময় নষ্ট  না করে পিশেমশাই এর ঝটিতি জবাবভুল হইতেই পারেআর এমন কিসু ভুলও নয়এত কথা কওনের কি আসে?”
পার্থ একেবারে নাককান কাটা অবস্থাপ্ল্যান একরকম ভন্ডুল

আমার মেজো পিশেমশাই ছিলেন একেবারে উল্টো মেজাজেরমিষ্টি স্বভাবএকেবারেই বাঙাল সুলভমানুষ কে ফাঁসির খাওয়া খাওয়াতে উনি খুব ভাল বাসতেন এটাই একটু আপত্তির ছিলতাছাড়া পরিবারটি ছিল খুব মানব দরদীএখনও তাইপিসতুতো দাদাদের ভাতের থালা ভিখিরির হাতে তুলে দিতেও দেখেছিমেজো পিশেমশাই ভাগলপুরে মেয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছেনরিকশা নিয়ে শহর ঘুরতে বেরিয়ে গেছেনফিরতে ফিরতে দুপুর গড়ায় প্রায়
পিশেমশাই জিগ্যেস করেন কত ভাড়া হল ভাই ? সেই সকাল থেকেই ঘুরছেনরিকশাওলার ভাড়া শুনে তিনি চমকে উঠলেনএতো কম ? চোখের সামনে রিকশাওলার ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীরমাথার ওপর গনগনে রোদপিশেমশাই ভাড়ার টাকা হাতে নিয়ে কাতর ভাবে তার নিজস্ব হিন্দি তে বলে ওঠেনআচ্ছা রিকশাওলা ,তুমকো ইস ভাড়ামে পোষায় গা তো ?”

কোথায় গেল সেই সব ভেজালহীন ভানহীন নিজস্ব ভাবনা চিন্তার অদ্ভুত মজার মানুষগুলোযাদের মস্ত পাখার ওমের তলায় আমরা ছানারা কেমন গুটিশুটি মেরে বসে থাকতামসেই পাখাগুলো আর নেইতাই আমাদের  আজকাল বড় শীত করে

তারা কেমন অনাবিল আনন্দ দিতেন উপকরণ তেমন ছিলনা কিন্তু অন্তঃকরণের কোন অভাব ঘটেনিঠিক এখনকার উল্টোটাকত কৌতুক , বিস্ময় ,কত বোকা বোকা স্বপ্নসেগুলো কুড়িয়ে নেবার মত কেউ নেই আর এখন

বৃষ্টি ভেজা রাতে যেন কোথাও ফোটে হাস্নুহেনা
মুঠো তোমার আলগা কর
কেউ থাকে না কেউ থাকে না” (বাসুদেব দেব)

হাওয়া ফিসফাস হাওয়া ফিসফাসকিন্তু ওরা বলে, সে কী কথা? আমরা আবার গেলাম কোথায়? বুঝতে পারিস না কেমন হাওয়া হয়ে চুলে বিলি কেটে দিই, রোদ্দুর হয়ে জড়িয়ে ধরি, বৃষ্টি হয়ে তোর বারান্দার ফুল গাছগুলোকে ভিজিয়ে দিই , একটুকরো জ্যোৎস্না হয়ে তোর বিছানায় পড়ে থাকিকাক হয়ে বিস্কুট খেয়ে যাই, কাঠবিড়ালি হয়ে বাদাম মুড়ি খেয়ে যাইবুঝতে পারিস না?
মহীয়সী উবাচ , হারায় নাই কিসু, খুঁজিয়া পাইতাসি না

1 comment:

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com