বীরভূমের 'কুড়ুখ্ কাতথা' পশ্চিমবঙ্গের ওরাওঁ সংস্কৃতি ও সাহিত্যের একমাত্র মুখপত্র
বোলপুর
থেকে নিমাই কুমার সর্দার সম্পাদিত
এই 'কুড়ুখ্ কাতথা' কুড়ুখ্ ভাষায় প্রকাশিত
হলেও প্রকৃতপক্ষে ওরাওঁ আদিবাসীদের ভাষা-সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি
ও লোকাচার বিষয়ে এটি একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণামূলক পত্রিকা!
পশ্চিমবঙ্গের
যে ত্রিশটি জনজাতির ভাষাকে ইউনেস্কো বিলুপ্তপ্রায় ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে ওরাওঁদের এই কুড়ুখ্
ভাষা অন্যতম। বিশ্বের
প্রাচীনতম উন্নত সিন্ধুসভ্যতায় মানুষজন 'ব্রাহুই' ভাষায় কথা বলতেন।
এই ব্রাহুইভাষীদের লিপিই 'ব্রাহ্মী'। সিন্ধুঘাঁটির অধিকাংশ মানুষই ছিলেন 'দ্রাবিড়িয়ান' ভাষা পরিবারের সদস্য।
ভাষাবিদদের একাংশের
মতে ব্রাহুই ভাষা ছিল 'মালতো' ও 'কুড়ুখ্' ভাষার শাখাভুক্ত উত্তরাঞ্চলের তখনকার
দ্রাবিড়দের উপভাষা।'কুড়ুখ্'
এই দ্রাবিড়গোষ্ঠীর ওরাওঁ-দের
মাতৃভাষা।
সম্ভবত এই দ্রাবিড়
জনজাতি উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে অতীতে কোনও একসময় দক্ষিণভারতের
কর্ণাটকের কুর্গ অঞ্চলে এসে বসবাস
শুরু করে। খ্রীষ্টপূর্ব
প্রায় দু' হাজার বছর আগে এই জনজাতির
ভারতে আগমন বলে দাবি করেছেন জিতু ওরাওঁ তাঁর ' সিন্ধুঘাঁটি কুড়ুখ্ সভ্যতা ও
জনজাতির ভূমিকা' গ্রন্থে।
কর্ণাটক থেকে এই
উপজাতি কিছু সময়ের জন্যে আরামনগর বা আরা
ও বক্সার হয়ে শেষমেশ আশ্রয় নেন
রুইদাসগড় বা এখনকার রোটাসগড়ে। আরও পরে উত্তর-পূর্বে এসে এঁরা একসময় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম আর বাংলাদেশে বসতি গড়ে তোলে।
এখন পশ্চিমবঙ্গে প্রায় পনের লক্ষ ওরাওঁ
জনজাতির মানুষের বাস।
ওরাওঁ-দের 'তোলোং
সিকি' বা 'কুড়ুখ্' বর্ণমালা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৫ মে ১৯৯৯ সালে।
ঠিক তার আগের বছর ডা. নারায়ণ ওরাওঁ কুড়ুখ্ বর্ণপরিচয় তথা 'কাইলগা' নামের একটি
পুস্তক রচনা করেন। ২০০২ সালের ২০ শে নভেম্বর 'তোলোং
সিকি'-র প্রথম কম্পিউটার ফন্ট তৈরি হয় এবং পরবর্তী বছরগুলিতে ঝাড়খণ্ডের কয়েকটি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই লিপি চালু করা হয়। ২০০৯ সালের
২০ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ড সরকার প্রথাগতভাবে কুড়ুখ্ ভাষাকে রাজ্যে স্বীকৃতি দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের
মুখ্যমন্ত্রী 'ভাষা
শহিদ দিবস' উদযাপন মঞ্চ থেকে কুড়ুখ্ ও রাজবংশী এই দুই জনজাতীয় ভাষাকে
সরকারি স্বীকৃতি দিলেও ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিলিতে অন্তর্ভুক্তির দাবি নিয়ে
ওরাওঁ আদিবাসীদের ধারাবাহিক দরবার এখনও
চলছে।
'কুড়ুখ্ কাতথা' পশ্চিমবঙ্গের ওরাওঁ সম্প্রদায়ের এই প্রথম ও
একমাত্র মুখপত্রটি প্রকাশের এক দশক পূর্ণ করল।
২০১০সালে
বোলপুরে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত জেলা থেকে আগত প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ও মতামতে
ওরাওঁ আদিবাসীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য 'সারা ভারত ওরাওঁ কল্যাণ সমিতি' প্রতিষ্ঠিত হয়।সমিতির
সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে
নিমাই কুমার সর্দার ও বৈজু ওরাওঁ। পশ্চিমবঙ্গে
ওরাওঁ আদিবাসী সম্প্রদায়ের এটিই একমাত্র সর্বভারতীয় রেজিস্টার্ড সামাজিক সংগঠন।
আঞ্চলিকতার
প্রভাবদুষণে বিধ্বস্ত ওরাওঁ-দের ভাষা
ও সংস্কৃতির হৃতমর্যাদা পুনুরুদ্ধার করে তাঁদের নিজেদের লুপ্ত আচার বিধি, লোক-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, উৎসব-পার্বণ, সাহিত্যচর্চার বিস্তার ও উন্মেষের
জন্য সংগঠিত
একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিরন্তর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে চলেছে এই ওরাওঁ
কল্যাণ সমিতি।
শরৎকালে
ধামসা-মাদলের তালে তালে করমপুজোয় মেতে ওঠে সমগ্র ওরাওঁ সমাজ।
করম উৎসবে বিভিন্ন জনমনোরঞ্জনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওরাওঁ-দের নিজস্ব
কুড়ুখ্ ভাষার প্রচলন বাড়ানোর জন্যে এই কল্যাণ সমিতি সদাসচেষ্ট।
সেই
২০১১ সাল থেকে কুড়ুখ্ ভাষার বিস্তার ও প্রচারের জন্য এবং তাঁদের নব-আবিষ্কৃত লিপি 'তোলোং
সিকি'-র সাধারণগ্রাহ্যতা বাড়াতে এই সমিতিটি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত
এলাকায়, গ্রামগঞ্জে ছোট ছোট সভা ও
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ওরাওঁদের সচেতন করবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
বীরভূম জেলার সিউড়ি, দুবরাজপুর, সাঁইথিয়া, নলহাটি ও রামপুরহাটের বিভিন্ন অঞ্চলে 'সারা ভারত
ওরাওঁ কল্যাণ সমিতি' গ্রাম ভিত্তিক নিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষকদের মাধ্যমে 'তোলোং
সিকি' লিপির চর্চা ও কুড়ুখ্ ভাষা শেখানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৭ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক
রাঁচির রানি খাটাঙ্গায় ওরাওঁ আদিবাসীদের জীবনযাপনের একটি প্রস্তুতিমূলক তথ্যচিত্র 'Oraon, on
the life of the Adivasis'
নির্মাণ
করেছিলেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের "সেন্টার ফর এনডেঞ্জারড্ ল্যাঙ্গুয়েজেস" বিভাগ
কুড়ুখ্ ভাষায় শিক্ষা ও পঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বিশ্বভারতী প্রকাশিত সাম্প্রতিক বইটি "বেসিক প্রাইমার অফ কুরুক্স/ওরাওঁ"
এই উদ্যোগে এক অনস্বীকার্য অবদান। রবীন্দ্রনাথ তো এমনটিই
চেয়েছিলেন।
No comments:
Post a Comment