একটি আষাঢ়ে গল্প
পিরানি - জায়গাটা
মন্দ না। সমুদ্রের ধারেই, পূর্ব উপকূল। বিস্তৃত বালিয়াড়ি। তারপরে ম্যানগ্রোভ্ এর ঝোপ, নারকেল আর খেজুর গাছের সারি। সারাদিন
ঝড়ের মত হাওয়া। বিভিন্ন পাখি সমুদ্রের তীর বরাবর উড়ে বেড়ায়। ওদের কলতান সমুদ্রের শব্দের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত
সিম্ফনি’র সৃষ্টি করে। বালির ওপর পাঁশুটে আর লাল রঙের কাঁকড়া ছুটে বেড়াচ্ছে সারাদিন। পর্তুগিজ আর
ইংরেজদের হাতে জায়গাটা গড়ে উঠেছিল শুনেছি। সাহেবরা নাকি বন্দর বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয়
নাব্যতা ছিল না। তবে সামুদ্রিক তৎপরতা যে ছিল সেটা বোঝা যায়। বিশাল কিছু ভাঙ্গা জেটি আজও পড়ে
রয়েছে। সমুদ্র দূরে সরে যাওয়ার জন্য দেখতে অদ্ভুত লাগে, মনে হয় যেন মাঝপথেই থেমে
গেছে। সব মরচে পড়ে কালো, তবু আছে। বই পড়ে তৈরি পর্যটক এখানে সাধারণত আসেনা; নতুন সৈকত
বা নির্জন জায়গা খুঁজে বেড়ায় যারা তারাই হঠাৎ হঠাৎ চলে আসে। জনসংখ্যায় ধনী আমাদের
দেশে এই রকম ভার্জিন জায়গা পাওয়াই দুস্কর। শহরের দিকটা ছোট্ট। তাপ উত্তাপ এত কম যে গ্রামাঞ্চল বললে অত্যক্তি হয়না। তবে সরকারি হিসেবে মিউনিসিপ্যালিটি। হোটেল এক-দুটো। খারাপের দিকে। তাই থাকা-খাওয়ার খুব সমস্যা। থাকার
মধ্যেএকটা বাজার। যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম বাস। তবে রাস্তা ঘাট বেশ সুন্দর। ফুটপাথ
রয়েছে তার পরেও অনেকটা জায়গা। পোস্ট অফিস, টেলিফোন অফিস, একটা জেলখানা আর পুরোপুরি
বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা রেলওয়ে স্টেশন। অন্তত একশ বছরের পুরোনো । মিটার গেজ এর লাইন প্রায় হাফ কিলোমিটার গিয়ে মাটি
চাপা পড়ে উই-এর ঢিবি হয়ে গেছে। নিরিবিলি, জঙ্গলময়, দিনের বেলাতেই গা ছমছম করে। বহুদিন ধরে পরিত্যক্ত
হওয়ার ফলে একটা যুগ কে নিজের গোটা গায়ে মেখে ঠিক যেন ইন্সটলেশন। কিন্তু কোন অজানা
কারনে জায়গাটা এভাবেই পড়ে আছে সারা গায়ে অযত্নের ছাপ নিয়ে।
প্রথমবার
আমার এখানে আসা হঠাৎ-ই। শুভ্র এসেছিল এক্সপ্লোর করতে। কয়েকদিন থেকে খেয়াল হল একটা হোটেল করলে কেমন হয়।
ও এরকমই। পয়সা কড়ির অভাব নেই। এক স্থানীয় জেলের জায়গা, সমুদ্রের ধারেই। জেলের সাথে রফা করার জন্য আর সরকারি
ব্যাপার গুলো সারতে আমার দরকার হল। আমি কলমচি। সরকারি কাজের গৎ টা বুঝি। এক
সপ্তাহের মধ্যে পেপার ওয়ার্ক সেরে ফিরে আসি।
পরের আসা
দুবছর পরে। মাঝে অনেকবার ডেকেছে। পারিনি। ফোন পেলাম, বিশেষ দরকার, আসতে হবেই, নহলে নাকি
সব শেষ।। ছুটি ম্যানেজ করলাম। যেতে প্রায় ঘণ্টা চোদ্দ। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্টেশনে। ইতিমধ্যে
হোটেল তৈরি হয়েছে, ব্যবসাও। খুব সুন্দর দেখতে। ছোট্ট, চারটে
রুম। ফেসবুক এ আগে ফোটো দেখেছিলাম। সামনে থেকে আরো সুন্দর লাগছে।
কেমন হয়েছে?
হুঁ দারুন! জায়গাটা তো আগের বারেই খুব ভাল লেগেছিল। দুবছরে পয়সার গতিও বেড়েছে। পাশে একটা ফুড প্রসেসিং ইউনিট
হয়েছে দেখলাম।
হ্যাঁ
আমাকেও শেয়ার অফার করেছিল, পাত্তা দেইনি। সব কালো ধান্দা বুঝলি?
তারমানে
এবার জায়গাটা যাবে।
হ্যাঁ,
সেটাই। তবে ট্যুরিস্ট এখনও
খুব কম।
জলযোগের পরে
চারপাশ টা একটু ঘুরে দেখতে গিয়ে একটু বেলা করে ফেললাম। শুভ্র আমায় ফোন করে পায়নি।
সিগন্যাল এর খুব সমস্যা। নতুন জায়গায় হারিয়ে যেতে পারি তাই খুব চিন্তা করছিল।
হল কি? এরকম
মাতৃসুলভ চিন্তা?
আরে
ব্রাদার, বয়েস হচ্ছে তো।
বয়েস! পরের চমক
টা কি? আমি অবাক হলাম।
না না তেমন
কিছু না।
গল্প করতে করতে
দিনটা কেটে গেল। শুভ্র আমায় কোন বিশেষ কাজে ডেকেছে না জাস্ট গল্প করতে সেটা বোঝা
গেলনা ।
ডিনার
টেবিলে জিজ্ঞেস করলাম আমায় তলব কি বিশেষ কোন কারনে। না হলে বেশিদিন
সরকারি চাপ বাড়াবো না।
হাসি – না
তেমন কিছু না। ঐ ভাবছিলাম বিয়ে করলে কেমন হয়।
আমি অবাক। আমরা
দুজনেই বেয়াল্লিশ। আর বিয়ে? ওর মত বোহেমিয়ান না হলেও সংসারে অন্তত আমার মতি নেই। এরকমই
কাটিয়ে দেব ভেবেছিলাম। সেখানে শুভ্র!
আমার মুখে
বিস্ময় দেখেই লজ্জা পেল। না করছিস . . .?
না না অসুবিধে
নেই। করতেই পারিস। সব কিছু ঠিক আছে তো? চোখ মারলাম।
হাঃ হাঃ
হাঃ, তুই বাঁ**একি রকম
এই তো
চোয়াড়ের মুখ খুলেছে। হাসলাম।
একটি মেয়ে
শুভ্রর মনে ধরেছে। বিয়েতে অ্যালার্জি থাকতে পারে, মেয়েতে নয়। এই
সুন্দর জায়গা, তায় নভেম্বর এর শেষ, তার ওপর মেয়ে। আমায় আর পায় কে, আগে বিয়ে হোক তো। খুব ইয়ার্কি
মারলাম। কতদুর গেছে, মানে ঠিক কতদুর, তদন্ত করলাম।
শুনলাম দেখা-সাক্ষাত
খুব নিয়মিত হয়না। বাঙালী কিনা জানেনা, তবে বাংলা বলতে পারে। কোথায় সে থাকে তাও অজানা। অসম্ভব আকর্ষণীয় এই
বালিকা নাকি যেকোনো পুরুষের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করানোর ক্ষমতা ধরে। হয়েছে অনেককিছুই, তবে শুভ্রর ইচ্ছায় কিছু হয়না। জোর-টোর ঠিক চলেনা বুঝলি? এক
আদিম আকর্ষণে বাঁধা পড়েছি।
ভালই ঘোল
খাইয়েছে দেকছি। শালা নাড়ী নক্ষত্র কিছুই জাননা বিয়ের পিঁড়িতে বসবে! বান** আর কাকে বলে। বিয়ের
কথা বলেছিস?
হ্যাঁ, ঘোল
খেয়েছি। অকপট স্বীকৃতি। একটা যুবতী মেয়ে আসে, আমার সাথে গল্প করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
লোকাল লোকজন দেখেছে। এখানে দুবছর আছি তাও এরা আমাকে বাইরের লোক বলেই মনে করে। বিয়েটা
না করলে একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে, বুঝলি? ব্যাবসা করে খাই তো। তবে যেটুকু খবর
পেয়েছি মেয়েটি স্থানীয় নয়। আমার দু তিন জন কর্মচারীকে জিগ্যেস করেছি ওরা চেনেনা।
ওদেরও ধারনা বাইরের। বলে তো অনেক দূর থেকে আসে। কি করে আসে যায় কিচ্ছু জানিনা।
বলতে বলতে
শুভ্র আনমনা হয়ে পড়ল ।
ভাল। তুই
এযাত্রায় প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ কর, যদি আর কিছু ভঙ্গ না হয়, ইয়ে মানে যদি রসভঙ্গ না হয় তাহলে
পরের ফাগুনে আমিও। খুব হাহা-হিহি হল। আমার আসাটা সার্থক হল। তো কবে দেখব তাকে? চোখ
মারলাম।
হুঁ, সে
জন্যই তো তোমায় ডাকা বন্ধু।
কেন আমি
উদ্বোধন করব নাকি?
নারে, আমি
তো এরাটিক। তুই অনেক সাব্যস্তের। বুঝবি ভাল।
তবে আর দেরি
কেন? কালকেই ব্যবস্থা কর। ভাল জব্দ হয়েছিস। আমার আনন্দ হচ্ছে, তবে না দেখে কিছু
বলবো না।
#
রেবতীর সাথে
আমার আর দেখা হয়নি। খুব গাল মন্দ করে ফিরে এসেছি। সবকিছু ভাল ভাবে হলে
খুশিই হব। আগ্রিম বিয়ের শুভেচ্ছাও জানিয়েছি। শুভ্র কিন্তু খুশী অখুশীর মাঝামাঝি একটা অদ্ভুত মুখ করে ছিল
বরাবরই। যাইহোক বিয়ের নেমন্তন্নের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু ডাকটা পেলাম
অন্যরকম। শুভ্রর কর্মচারী গজাননের ফোনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শুভ্র নেই! আস্বাভাবিক মৃত্যু। ওর পরিবারের কাউকে
ওরা চেনেনা, তাই আমায় . . .
আমরা কলেজের
বন্ধু, বাড়ীতে যাতায়াত ছিল। বিশাল সম্পত্তির মালিক ওরা দু ভাই। দেড়শ বছরের সোনার
ব্যাবসা। শুভ্রর এসবে মন ছিলনা কিন্তু টাকা পয়সায় আগ্রহ
ছিল। আনলিমিটেড ফোটাত। এক
পয়সাও ছাড়েনি। বাবা-মার মৃত্যুর পরেই নিজের ভাগ বুঝে শুভ্র গ্লোব ট্রটার হয়ে গেল।
বাড়ীর সাথে যোগাযোগও রাখত না। একবার ওর দাদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল, ভাই হোটেল করেছে
জেনে খুশি হয়েছিল।
খবরটা জেনেই
ছুটলাম ওদের দোকানে। খবরটা দিতেই শুভ্রর ভাইপো গদি থেকেই ফোন করে করে রাষ্ট্র করে
দিল। আমি চলে আসছিলাম কিন্তু সে বলল, আপনিই একমাত্র কাকার হদিস জানেন। আপনাকে
যেতেই হবে। আমি যাব আপনার সাথে বডি আনতে। প্লিজ না করবেন না।
#
ভোরবেলায় সমুদ্রের
ধারে দেহ পাওয়া যায়। পুলিশ বডি ছাড়ার পড়ে দেখলাম . . . বীভৎস! এভাবে দেখা হবে ভাবতে পারিনি। চেনা যাচ্ছেনা। অন্য
প্রাণী মনে হচ্ছে। গোটা শরীর থেঁতলে গোলগাল হয়েগেছে। গায়ের রঙ পুরো কাল। দেহের ধার বরাবর পাঁচ-ছটি গভীর ক্ষত। দুদিকেই। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। জিভও বাইরে
বেরিয়ে গেছে। মানুষের জিভ যে এত বড় হয় সেদিন জানলাম। পোস্ট মর্টেম হয়ে আরও ভয়াবহ
লাগছে। বসে পড়লাম। বমি পেল। ডাক্তার জানাল, বিষক্রিয়ায় পুরো
শরীর পচে গেছে।
পুলিশ বোকা
বোকা প্রশ্ন করে তাদের কাজ শুরু করল যেটা একদমই কনভিন্সিং মনে হলনা। ক্ষতের কারন
কি, বিষের উৎস কি বা সমুদ্রের ধারেই বা ও কি করে গেল এসব কোন কিছুই জানা গেল না। যাবে
বলেও মনে হলনা।
লোকাল লোকজন
ফুল, সুগন্ধি আর বরফে শুভ্রকে ঢেকে দিল। দেখি ফুড প্রশেসিং এর লোকগুলোও এসেছে।
আমার তো এদেরকেই সন্দেহ হচ্ছে। ওদের অফার নেয় নি। জানিনা শত্রুতা তৈরি হয়েছিল কিনা। স্থানীয়
মানুষজন আর হোটেলের কর্মচারীরা চেয়েছিল শেষকৃত্য এখানেই করতে। ওরাও এই কবছরে
বাঙ্গালি বাবুটিকে বেশ ভালবেসে ফেলেছিল। কিন্তু পারিবারিক দাবির কথা মত আমরা বডি
নিয়ে ফিরে এলাম। তবে আমার চোখ ভিড়ের মধ্যে রেবতীকে খুঁজেছিল।
#
ভেবেছিলাম
পিরানির সাথে বুঝি সম্পর্ক শেষ, কিন্তু তা হলনা। মাস খানেকের মধ্যেই
আমাকে আবার যেতে হল। শুভ্রর দাদা আমায় অনুরোধ করলেন ওখানের সমস্ত ব্যাবসা লিকুইডেট
করে পুরো টাকাটা বুঝে নিতে। যেহেতু আমি ওখানে যেতাম তাই ওদের ধারনা হয়েছে আমি এটা
পারব, তবে ওনারা সঙ্গে থাকবেন। সোজা কোথায় দালালি, যার জন্য
শুভ্রর দাদা নির্লজ্জের মত আমায় একটা শতাংশ অফার ও করলেন।
এ কাজটায় আমি
না করতেই পারতাম। রাজি হলাম কৌতূহলে। যদি শুভ্র খুন হয়ে থাকে তাহলে সম্পত্তি একটা কারন হতেই পারে। তাই আমার ধারনা প্রপার্টি ডিস্পোসাল
এর অছিলায় এই মৃত্যুর একটা ব্যাখা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। হয়ত এমনও হতে পারে যে স্থানীয় কোন চক্র এর পিছনে
রয়েছে, পুলিশও মিলেমিশে রয়েছে। তাই কোন তদন্তই হল না। হয়ত সেই মেয়েটিও এতে যুক্ত। আর তাই যদি হয় তাহলে
খুবই সাবধানে কাজ করতে হবে, যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি তাহলে আমার প্রাথমিক কাজটাই
হবেনা এমনকি ঐ পরিণতিও হতে পারে।
#
অঘটনে
মৃত্যু অতএব হোম সহযোগে শান্তি সংস্থয়ন না করলে এই প্রপার্টি কেউ নেবেনা। বোঝো
ঠ্যালা! শুভ্রর বাড়ীতে জানালাম। ওর দাদা সাধুবাদ জানালেন। তবে ওরা কেউ এক্ষুনি
আসছেনা, যা খরচা হয় আমি যেন এখান থেকেই নিয়ে নেই। শালা এবার এসবও আমায় করতে হবে! হাওয়া
খারাপ দেখে আমার দপ্তরে মেডিকেল ছুটির কথা বলে রাখলাম। পুরুত জোগাড় হল। ফর্দ
অনুযায়ী বাজার। যজ্ঞের আয়োজন হল। প্রতিবেশী দের নেমন্তন্নও করলাম।
পরের শনিবার
অনুষ্ঠান টা ছিল। স্থানীয়রা অনেকেই এসেছিল। দেখলাম সদ্য পাতকের রেপুটেশন ভাল। এই সুযোগে এই প্রপার্টি
নিয়ে পরিকল্পনাটাও জানিয়ে রাখলাম। একজন আগ্রহ দেখাল। বুঝলাম এই প্রোগ্রাম টা করে
কাজের কাজই হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য সেই মেয়েটি পুরো বেপাত্তা, এমনকি কেউ আমাকে সেই
ব্যাপারে কোন কিছুই বললও না।
রোববার দুপুরে
ঐ আগ্রহী আমার সাথে কথা বলে গেল। শুভ্রর উকিল ও এসেছিল। এই কাজে তার সহায়তাও
প্রয়োজন হবে। দিনটা বেশ লম্বা ছিল। সারাদিন সিরিয়াস কথা বলে বেশ টায়ার্ড লাগছিল।
একটা চা খেয়ে সমদ্রের ধারে চলে গেলাম।
সূর্য ডুবে
গেছে অনেক্ষন, আলো রয়ে গেছে। সমুদ্রের তো ছুটি নেই সে হাজার হাজার বছর ধরে এই একই
কাজ একই ভাবে করে চলেছে। এখানে এলেই বোঝা যায় আমরা মানুষেরা কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ।
সত্যি, এমন জায়গা খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এত বড় সৈকত, প্রায় জনহীন। প্রায় বলছি কারন
অনেক দূরে কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। জেলেও হতে পারে। আবার পর্যটক ও
হতে পারে। তবে খুব বেশি সময় থাকা যাবেনা, বেশি অন্ধকার হয়ে গেলে মুশকিল, আলোর কোন
বন্দোবস্ত নেই।
ভয় বলতে
জোয়ার এর সঠিক সময় জানিনা, সন্ধের পর থেকেই জল বাড়তে শুরু করে, তাই তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেই
ভাল। ফিরছি, অনেক্ষন হাঁটারপরে হটাত খেয়াল হল যেন রাস্তা আর শেষ হচ্ছে না। ইতিমধ্যে
চারদিক একদমই অন্ধকার ঘুটঘুটে। সেকি! হোটেলটা সামনেই। লোকালয়ও কিলোমিটার খানেক দূরে। কিন্তু কোন আলোই
যে দেখা যাচ্ছেনা। আমি কি পথ হারিয়ে ফেললাম! এদিকে পিছনে দানবীয় গর্জন বাড়ছে। জল কতটা এসেছে
বুঝতে পারছিনা। একবার দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম সমুদ্র কোন দিকে। চারিদিকেই এত
শব্দ হচ্ছে যে নিশ্চিত হতে পারছিনা। হু হু ভেজা বাতাসে মনে হল পেছনেই। যা হোক হবে
ভেবে যেদিকে যাচ্ছিলাম সোজা যেতেই থাকলাম। পথ শেষ হওয়ার নামই নেই। একটা কিছু
গোলমাল করেছি মনে হচ্ছে। ভয় লাগতে শুরু করল। ঘেমে উঠলাম। বেশ ডিপ্রেসড লাগছে। মন
শক্ত করে হেঁটে যেতে লাগলাম।
হটাৎ একটা
ছপ ছপ শব্দ! যখন খেয়াল করলাম তখন মনে হল একটু আগে থেকেই শব্দটা হচ্ছিল, গুরুত্ব
দেইনি। পেছনে কেউ আসছে! শেয়াল বা কুকুর? তাহলে এধরনের পা টেনে টেনে বা কোন
কিছু মাটিতে ঘষে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো শব্দ
হওয়ার কথা নয়। গা ছমছম করে উঠল। ঝট করে দাঁড়িয়ে সাহস করে পিছনে তাকাতেই থেমে গেল। চুপ!
শুধু একটানা ঢেউয়ের শব্দ। আবার হাঁটতেই শুরু হল। ঠিক যেন আমার পিছু নিয়েছে। কেউ কি
মজা করছে? এবার মনে হল আমারই চটির থেকে শব্দটা হচ্ছে। এটা মনে হতেই সাহস বেড়ে গেল।
এগোতে থাকলাম হন হন করে। শব্দও আমার পিছু নিল। পাত্তা না দিয়ে এগোতে লাগলাম। হটাৎ
দেখি দূরে বাঁ দিকে ঝুপ করে অনেকগুলো আলো একসাথে জ্বলে উঠল। চমকে উঠলাম! দাঁড়িয়ে
পড়েছি, শব্দও থেমে গেল। থামাটা শুনেই বুঝলাম এটা আমার চটির শব্দ নয়; আমার একটু পরে
থামল। গোটা শরীর ভার হয়ে এল। চোখে জল ভরে এল - ভয়ে । গলা কাঠ। আর পেছনে তাকানোর সাহস নেই। মাতালের মত টলছি
মনে হচ্ছে। কিভাবে যেন ছুটতে শুরু করলাম। ঐ সার বাঁধা চিক চিক করা আলোগুলোর দিকে। কিছুক্ষণ পরেই
বুঝতে পারলাম শহরের রাস্তার আলো। কেমন যেন ঘোরটা কেটে গেল। আরও জোরে ছুটতে গিয়ে
খেয়াল হল শব্দটা আর নেই। মনে ভিড় করে সাহস এল খুব। একঝটকায় পিছন ফিরতেই মনে হল . . . মনেহল অন্ধকারে কে
যেন দাঁড়িয়ে। গলা উঠিয়ে বললাম - কে? নিজের গলার আওয়াজ নিজেই চিনতে পারলাম না।
ঘসঘসে চাপা আওয়াজ আর্তনাদের মত শোনাল। কে ওখানে? হাল্কা মেয়েলি স্বরে হাসির শব্দ
হল যেন! ঠিক শুনলাম? তারপরেই মনে হল বালির ওপর ঘষটে কিছু টানতে টানতে কেউ আরও
অন্ধকারের মধ্যে চলে যাচ্ছে . . . আরও অন্ধকারে . . . সমুদ্রের দিকে। দূরে দীর্ঘশ্বাসের
মতো সমুদ্রের ডাক। অন্ধকার নিশ্চুপ। গোটা গায়ে শীতকাঁটা। চোখ, নাক দিয়ে জল
বেরচ্ছে। অসুস্থ লোকের মত ঘড়ঘড়ে, ভাঙ্গা গলায় আওয়াজ বেরল ওহ! মা! আমি আর আমার
মধ্যে নেই। পা নড়ছে না। বোধহয় ছোটার চেষ্টা করলাম। পারলাম কি?
যেন
দুঃস্বপ্ন দেখে উঠলাম। গোটা গায়ে ব্যাথা। পঙ্গুর মত বিছানায়। গোটা জামা কাপড় ভেজা
আর বালিতে ভরা। হাত গুলো আঠা আঠা। উদ্বিগ্ন মুখগুলো ঝুলে আছে। গজা এন্ড কোং। ডাক্তার। জানলাম আমি বেরোনোর পর থেকে পুরো সন্ধ্যে লোডশেডিং ছিল। ফলে অন্ধকারে আমি দিশা
হারিয়ে অন্যদিকে চলে গেছিলাম। অনেক্ষন আমি না আসায় ওরা খোঁজাখুঁজি শুরু করে
হোটেলের কিছুটা কাছেই আমায় খুঁজে পায়। ওরা আমায় কেউ কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না। সব্বাই
আমায় সাবধানে থাকতে বলল ইনক্লুডিং ডাক্তার। ওরা ধরেই নিয়েছে আমার সাথে হোটেল মালিকের
প্রেতের দেখা হয়েছিল। আমার খুব বন্ধু কিনা। অপঘাতে মৃত্যুতে নাকি এসব সমস্যা হতে
পারে। ভুত, মামদো অবধি ঠিক ছিল কিন্তু পুরুষ কি করে পেত্নী হয় সেটা আমার মাথায়
ঢুকল না। আর যদি পথই হারিয়ে থাকি তাহলে হোটেলের কাছ অব্দি এলাম কি করে তাও বুঝলাম
না। সব হিসেব কেমন একটু গোলমাল মনে হল। সেদিন রাতেই একটু স্বাভাবিক হয়ে গজাদের
কাছে মেয়েটির খোঁজ নিতে জানলাম ওরা কিছুই জানেনা। শুভ্রর প্রেমের কথা শুনে ওরাও অবাক।
এখান থেকে
যেটা হতে পারে হয় এরা সবাই নাহলে শুভ্র মিথ্যে বলেছে। কিন্তু কেন? আবার আমায়, যে
কিনা ওর থেকে অন্তত পাঁচশো কিলোমিটার দূরে থাকে। আমার সাথেই বা আজ এটা কি হল?
#
শরীরটা একটু
বিগড়েছিল; মনটাও। যখনই মেয়েটির কথা ভাবছি মাথা ঝিমঝিম করছে। কোন হিসেবই মিলছেনা।
কেন আমাকে এসব কথা বলল? সবটাই কল্পনা। তাহলে কি মাথাটাই? সেজন্যই তো দেখা করাতে
পারেনি। ইশ! বেচারি! হয়ত খুব বিয়ের ইচ্ছে হয়েছিল। হ্যাঁ এমন বিকার এর কথা আমি শুনেছি। কি খারাপ
লাগছে। মনে পড়ছে আমার সাথে আলাপ করাতে পারলোনা বলে শুভ্রর মুখটা এই এতটুকু হয়ে গিয়েছিল।
পরের কিছু
দিন ব্যস্ততায় কাটল। কিছু ক্রেতা এল। ভালই দাম পাওয়া যাবে। মনে হয় এই মাসেই ঝামেলা মিটে যাবে। স্থানীয় লোকেদের
সন্দেহ করার ভাল কারন পাচ্ছিনা। আরও কয়েকজন কে মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। লাভ হল না। একবার দুম করে শুভ্রর
দাদাকেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম। সে তো আকাশ থেকে পড়ল! ভাবল প্রপার্টির কোন দাবিদার চলে এল
হয়ত। ওকে আশ্বস্ত করলাম।
#
একদিন
সন্ধেবেলায় শুভ্রর ঘরে গিয়ে, লজ্জা করছিল খুব, তবুও ড্রয়ার খুলে খুব খুঁজলাম কোন
ডাইরি বা কোন সুত্র পাওয়া যায় যদি। উঁহু। টাকা পয়সার হিসেব, অনেক ফোটো। ওয়ারড্রব ছিল একটা, সেটাও খুলে দেখলাম। ওপর ওপর। । বন্ধ করতে যাব এমন সময় কাগজ দিয়ে
মোড়া কিছু একটা ভাঁজ করা জামা প্যান্টের নীচে থেকে টুপ করে মাটিতে পড়ল। খুলে দেখি
দুটো কনডোম। কনডম! মানে! রেবতী? খারাপ পাড়া? সমকাম? এগুলো কীসের জন্য? এর থেকে
কিছু বোঝা যায়কি?
পরেরদিন
সকাল হতেই গজা কে জিগ্যেস করলাম ওর মালিকের স্বভাব কেমন ছিল। আগে প্রেমিকার খোঁজ
এবার পতিতা পল্লী। মাল রেগে কাঁই। ব্লাসফেমি। পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে দেখে চেপে গেলাম। আমার আরও সন্দেহ
হল গজাকেই আবার . . .? অস্বাভাবিক কিছুই না। গজাও বিয়ে টিয়ে করেনি, হয়ত ওরা ক্লোজ ছিল।
ঘুমোতে
যাওয়ার আগে একবার সমুদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। ভাল লাগে। সেদিনের কথা ভাবলে অস্বস্তিও
হয়। জোয়ার আসছে। গভীর রাতে সমুদ্র হোটেলের
একদম কাছে চলে আসে। গর্জন এ কান পাতা দায় হয়ে যায়। কিন্তু এই শব্দ শুনতে শুনতে
ঘুমোতে বেশ লাগে। আবার ভয় করে যদি ঘুমের মধ্যেই সমুদ্র গ্রাস করে নেয় গোটা হোটেল
টাকে। অস্বাভাবিক কিছুই নয়। প্রকৃতির সাথে মানুষের বিশ্বাস অবিশ্বাসের এক রহস্যময় ডায়ালেক্টিক
আছে। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল একটা ছোট্ট ঘড়ি। বই-এর র্যাকে। এক মুঠোয় চলে আসে। সাদা ডায়াল এর মধ্যে কালো হরফ। মাথার ওপর গোল গোল
দুটো অ্যালার্ম এর বেল। ভীষণ কিউট। দেখি আড়াইটের ঘরে অ্যালার্মের কাঁটা। অদ্ভুত তো! কোন আড়াইটে? দুপুর
না রাত?
অ্যালার্মের
শব্দ কানে যেতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল এক ঝটকায়। এইরে! এক খেয়ালে অন করে দিয়েছিলাম
বোধহয়। ঘর অন্ধকার, তাও একটা আলো রয়েছে। উঠে একটু জল খেলাম। শব্দে মনে হচ্ছে সমুদ্র
যেন ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম আবার। ঘুমের ঘোরটা ছিল তাই শুয়ে পড়তেই প্রায় চোখ লেগে এল। হটাৎ একটা অদ্ভুত আওয়াজে
স্নায়ু টানটান হয়ে গেল। সমুদ্রের একটানা গর্জনের মধ্যেও পরিস্কার শুনতে পেলাম। নাহ্ কোন ভুল নেই। সেই শব্দ! যেন কিছু ঘষে নিয়ে
যাচ্ছে। গোটা শরীর হিম হয়ে
গেল। শুভ্রর মরা মুখটার কথা মনে পড়ে গেল। ভয় ঘিরে ধরল আমায়। চোখ বন্ধ করে
ফেললাম। আবার। এবারে একদম সামনে দিয়ে গেল। বাইরের বারান্দা দিয়ে। কিছুক্ষন সব
চুপচাপ। হাত পা কাঁপছে, তবু যেন মনে হল আমি তো ভেতরেই আছি। ভয় কি? একটু সাহস এল
যেন। টর্চ টা শক্ত করে ধরে বিছানা থেকে নামলাম। দরজায় কান দিলাম। কোন শব্দ নেই। নিঃশব্দে
জানালার পর্দা সরিয়ে কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকালাম। আছড়ে পড়া জল বোধহয় হোটেলের নীচের
দেওয়ালে এসে লাগছে তাই জলের বাষ্পে জানালার কাঁচগুলো ঝাপসা। বাইরে একটা আলো আছে
বোঝা যাচ্ছে। আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে যেন হোটেলটাই জলের মধ্যে।
মিনিট দশেক
এভাবে কাটার পর আমার পৌরুষ ফিরে এল। প্রায় নিঃশব্দে দরজার ছিটকিনি, খিল খুললাম।
দরজা খুলতেই দমকা বাতাসের এক ঝটকা আর গুঁড়ো গুঁড়ো নোনা জলের কনায় মুখ ভিজে গেল।
চোরের মতো মুখ বাড়িয়ে টানা বারান্দার দুদিকে চাইলাম। কেউ নেই। এবারে বারান্দায় পা
দিলাম। খালি পা, পুরো মেঝেটাই ভেজা ভেজা লাগল। ডান দিক ধরে একটু এগোতেইপায়ে অনেকটা
জল লাগল। এতটা জল এল কি করে? আশ্চর্য। দেখি পুরো বারান্দাতেই জল। শেষ প্রান্তে
গিয়ে আবার ডানদিকের বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে উঁকি মারতেই গলা কাঠ হয়ে গেল। বুক ঢিপ
ঢিপ কয়েকটা মিস। আলো আঁধারিতেই দেখলাম ওদিকে শেষ প্রান্তে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে। দীর্ঘদেহী। মুখ সরিয়ে নিলাম। চোর হলে কাজ সেরে পালাবে, অপেক্ষা করবে কেন?
টর্চটা শক্ত করে ধরলাম, জ্বালাবার সাহস হল না। আবার উঁকি মারলাম। একটু ভাল করে দেখব বলে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নড়াচড়াও করছে । চুল ঠিক করছে। এত লম্বা চুল! শরীরের অবয়ব দেখেই চমকে উঠলাম।
এতো মহিলা! রেবতী? ভুত নাকি? ভুত কে মানুষ আড়াল থেকে দেখছে আর ভুত বুঝতে পারছেনা
ভাবনাটাই হাস্যকর। ভয়টা যেন কিছুটা কেটে গেল। কি করা উচিত। ডাকব নাকি? পিছন ফিরে এক
দৌড়ে বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকে পড়লাম। ইচ্ছে করেই দরজাটা সশব্দে বন্ধ করলাম। এবারে জানালার পাশে
দাঁড়ালাম। পর্দার আড়ালে। যা ভাবা তাই মুহূর্তে মেয়েটি ছুটে এল দরজার কাছে, তার
সঙ্গে ঐ শব্দ। দরজায় ঠেলা দিল একবার, দুবার। শরীরে ভয়ে কাঁপুনি ধরে গেল। আবার, প্রচণ্ড জোরে। ছায়া ঘোরা
ফেরা করছে বারান্দায় সঙ্গে সেই ঘষ ঘষ আওয়াজ! ঠিক কোন টিনের জিনিসকে মাটিতে টেনে
নিয়ে গেলে যেমন একটা অস্বস্তিকর আওয়াজ বেরয় তেমন।। মাটিতে বসে পড়লাম। পালাতেও
পারবোনা। মাথায় বদ বুদ্ধি খেলল। টয়লেটে গিয়ে মিউরেটিক অ্যাসিডের শিশিটা নিয়ে এলাম।
দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে দিলাম অনেকটা। হটাৎ ধুপ করে আওয়াজ হল একদম ডানদিকে। মনে হল
যেন বারান্দায় নামল। আমি একবার দরজাটা ঠুকে দিলাম। হ্যাঁ যেমন ভাবা তেমনি কাজ; ঘ্যাঁস
ঘ্যাঁস করে ছুটে এল দরজার সামনে, তারপরই একটা তীক্ষ্ণ অদ্ভুত আওয়াজ। মনে হচ্ছে
অ্যাসিডে পা লেগেছে। তারপরই এক প্রচণ্ড ধাক্কা দরজায়। দরজা তো খুলল না। আমি যতটা
জোরে পারি চেঁচালাম, কে? গলাটা বিকট শোনাল।
মেয়েলি
কণ্ঠে আওয়াজ এল - এটা কি হচ্ছে? দরজা খোল।
অবিশ্বাস্য! বাংলায় কথা বলছে।
আমি বিহ্বল।
কে তুমি?
দরজা খোল,
নাহলে ভেঙ্গে ফেলব। গলায় প্রত্যয়। আমার হাতে কোন অপশন নেই। আমি দরজার কাছে গিয়ে বোবা ধরা গলায় বললাম, খুলছি
খুলছি। ভয়ে একরকম কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুললাম। উগ্র মেছো গন্ধের সাথে এক ঝটকা
সমুদ্রের ভেজা হাওয়া ঘরে ঢুকল . . . আর তার সাথে সে . . . এক মানবী। আমি ছিটকে পিছনে চলে গেলাম। দানবী
বললেই বোধয় ঠিক হয়। প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা। লম্বা এলোমেলো চুল। ঘরে অন্ধকার বলে আর কিছুই দেখতে পারছিনা। আমি
প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লাম। মাটিতে বসে বললাম আপনি কে?
হটাত যেন
হাওয়ার ঝাপটা, শব্দ সব কমে কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। সেই পিছন ফিরে দরজা লাগিয়ে দিল। ‘আপনি
আজ্ঞে শুনেই বুঝেছি এ অন্য কেউ। ভয়ে একেবারে কেঁচো হয়ে গেছ যে! বলেই প্রায় ঝঙ্কার
দিয়ে হেসে উঠল।
ওর হাসিতে
আমি প্রায় চমকে উঠলাম। আপনি আমার কাছে কি চান?
চান? ফিক
করে হেসে - কিছুই চাইনা। যে থাকত সে কোথায়? তার সাথেই
দরকার। তুমি কে? এখানে তো তোমার থাকার কথা নয়।
সেতো নেই।
আপনি জানেন না? সে মারা গেছে।
মারা গেছে
মানে?
এই কথার আমি
কি উত্তর দেব বুঝতে না পেরে বললাম, আমার খুব অসুস্থ লাগছে। আমি কি একটু উঠে বসব?
একটু লাইট টা জ্বালাব?
অসুস্থ মানে
কি? তোমার যা ইচ্ছে কর। আমাকে জিগ্যেস করছ কেন?
ঈশ্বর! কোন
পাগলের পাল্লায় পড়েছি? কি করব, কি বলব, কিভাবে মুক্তি পাব?
থতমত। উঠে
যেই লাইটটা জ্বালিয়েছি সে ওমনি একটা অদ্ভুত, অজানা, তীক্ষ্ণ শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ
করে দুদ্দাড় করে দরজা খুলে বাইরে। বারান্দায়।
ওইটুকু সময়ে
দেখলাম বিশাল চেহারার এক যুবতী। একটা নীলচে সবুজ, ফুল ফুল, লম্বা ঝুলের ফ্রকের মত
পরে। হাত গুলো ফর্সা আর খুব লম্বা। মাথার চুল কোঁকড়ানো, খোলা। পিঠের নীচে ঝুলছে। মুখ দেখতে পাইনি। আমি ভয়ের চোটে সঙ্গে সঙ্গে স্যুইচ
অফ করে দিলাম। অনুরোধের সুরে জিগ্যেস করলাম নাইট ল্যাম্প টা জ্বালাই? আপনাকে তো
জিগ্যেস করেই ইয়ে . . .
হ্যাঁ হ্যাঁ
ঠিক আছে। একটু সহ্য হতে সময় লাগে তো . . .
কেন? কোন
উত্তর নেই।
নাইট
ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বললাম, ভেতরে। সে বলল, ঠিক আছে। বাইরে থেকেই জিগ্যেস করল এবার বল সে লোক
কোথায়?
উফ বললাম তো
আমার বন্ধু আর বেঁচে নেই, তার অঘটনে মৃত্যু হয়েছে। সেতো হয়ে গেল বেশ কয়েকদিন।
নির্দ্বিধায় তুমি তে নেমে এলাম। কেন তুমি জাননা? এখানে সব্বাই জানে।
অন্ধকার
চুপচাপ।
কি হল? চলে
গেলে নাকি?
ভারী দীর্ঘশ্বাস
পড়ল। ভেতরে এসে ঢুকল। নীল আলোয় ওকে পুরো নীল পরী বা পেত্নী মনে হচ্ছে। শুনেছি
পেত্নীরা নাকি খুব সুন্দরী হয়। এই অল্প আলোয় দেখলাম মুখের মধ্যে কমনীয়তা আছে। কিন্তু দেখতে খুব
অন্যরকম। চোখগুলো বোধহয় টানাটানা। মেক্সিকান অভিনেত্রী দের দেখেছি, তাদের মতই লাগছে।
লম্বা ঝুলের জামার জন্য পা দেখা যাচ্ছেনা। আমার দিকে তাকাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছিনা।
এতক্ষনে আমার কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে। ওকে হাত দিয়ে খাটের অন্য কোনাটা দেখিয়ে
বললাম, বোস। নিশ্চয়ই বুঝেছ আমি সে নই। আমি ওর বন্ধু। ও মারা গেছে বলে এসেছি। এই হোটেলটা
বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তো। আসলে আমি বুঝতে পারছিনা এত রাতে তুমি এখানে কি করছ? তুমি কি রেবতী? তুমি কি
বাঙালি?
অতিথি একটু
যেন হাসল। আমি ওর চোখ মুখ খুব পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিনা। তবু যেন মনে হল একটু
বিড়ম্বিত গোছের ভাব। বলল ‘আমি তোমার কথার মানে বুঝতে পারলাম না। তবে এটা বুঝতে পাচ্ছি যে এখানে যে
থাকত সে নেই। আসলে আমরা একসাথে ছিলাম। আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি। অন্ধকার হয়ে গেলে
ঘণ্টা বাজাত, আমি আসতাম। আমরা খুব ভাল ছিলাম। খুব মজা করতাম। ও খুব ভাল। আমাদের
কোন মিল নেই. . . তবুও ওকে আমার ভাল লাগত। ওরও আমায়। আসলে আমার কারোর সাথে ভাব হয়না। নিজের যারা তাদের থেকেও
দূরে দূরে থাকি। সময় কাটত না। একদিন সন্ধ্যায় ওর সামনে আচমকা চলে গেলাম। ও এখানে থাকত আমি জানতাম।
দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। সবসময় একাই দেখতাম। ভাবতাম বুঝি আমার মতই একা। তাই হুট করে একদিন
সামনে চলে এলাম। আমার রুপে আর ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিল’। মেয়েটি হেসে উঠল। হাত তুলে
মাথার চুল ঠিক করল। সাদা পেলব বাহু। সরু সরু আঙ্গুল। নেশা ধরা হাসি। যেকোনো পুরুষেরই ভাল লাগবে। জৈবিক কারন ছাড়াও মেয়েটিকে
খুব সরল সোজা বলেই মনে হচ্ছে। হটাত মনেহল আমার দিকে অন্য ভাবে চেয়ে আছে।
অস্বাভাবিক দৃষ্টি। বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল। বলল, ‘কি দেখছ? আমার চেহারা? আমার রূপ,
যৌবন?’ হাসি। ‘কি যে করি। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আমার ইচ্ছে মতো। তোমার সাথে দেখা করব বলে
বেশি রূপশী হয়ে এলাম।’ আবার হাসি, খিলখিল করে। ‘সেও পাগল হয়ে গেছিল। আমি বুঝেছিলাম
আমার সাজগোজ একটু বেশি হয়ে গেছে। পরে আর বদলাইনি। ওর ভাল লাগত বলে। পাগলের মতো
আমায় ধরে থাকত। পেরে উঠত না আমার সঙ্গে। খুব নাকাল করেছি ওকে।’ হাসি।
আমি স্তব্ধ। এমন মানবী যে পৌরুষের হুঙ্কার দেয়,
এ আমার জীবনে প্রথম। আমি একটা ঘোরের মধ্যে প্রায়। সে বলে চলে। ‘বর্ষায় যখন আমার
অবস্থা খারাপ, জোর করতাম। ও পারত না। তাও চেষ্টা করত বেচারা। আমায় ও সামাল দিতে পারে নাকি? অন্য কেউ আমার কাছে আসতে
চাইলে ও খুব রেগে যেত। আমি আর কি করব। আমায় দেখেই বুঝে যেত। কি রাগ!’ আমার মাথা
ঘোরাচ্ছে। এই সব কথার মানে কি? একি সেক্স ওয়ার্কার নাকি? এমন ভাবে বলছে যেন
প্রিমিটিভ সোসাইটি। ফ্রি সেক্স, ফ্রি মিক্সিং! এ হয় পাগল নাহলে পেত্নী নাহলে কেউ
প্ল্যান করে আমায় বোকা বানানোর জন্য একে পাঠিয়েছে।
কিছু বলার আগেই ও আবার শুরু করল।‘ আমায় রেবতী
বলে ডাকত। কেন জানিনা। এটা নাকি নাম! ও যেমন শুভ্র। আমি না করিনি। আমি আসলে ওকে
ভালবেশে ফেলেছিলাম। ঘণ্টা না বাজলে আসতাম না। ও না করেছিল। কাল আবার ঘণ্টা বাজল। চলে এসেছিলাম। দেখি দরজা বন্ধ। ডাকলাম। সাড়া
পেলাম না।’
আমি
কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। সেও দেখি চুপচাপ। তারপর বলল, ‘ওকে বেশ কিছুদিন ধরেই দেখতে
পাইনি। তোমাকে দেখছি এখানে থাকছ। সেদিন তোমার পিছু নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তখনই
জিগ্যেস করব। যা ভয় পেলে।’ হাসি। ‘ওও খুব ভয় পেয়েছিল শুরুতে। তোমারও ভয় কেটে যাবে।’ এই বলেই হঠাৎ আমার দিকে
সরে এল। আমি একটু চমকে উঠলাম। হাত বাড়িয়ে বলল ‘তোমরা তো এভাবেই বন্ধুত্ব কর, তাই
না?’ করমর্দন এর আহ্বান। পেলব অথচ দৃঢ় হাতটা ধরে একবার ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দেব। কিন্তু দেখি ও ছাড়ছে না।
কি আমার
বন্ধু হবে?
আমি বোকার
মত মাথা নাড়লাম। ওর আন্তরিক প্রশ্নে আর ছোঁয়ায় আমার মুখে কথা সরছেনা। বলে ‘উঠে এস
না এখানে, আমার কাছে।’ আমি হতবাক। এটা কেউ যে কোন পুরুষকে প্রথম আলাপে বলতে পারে
সেটাই আমার সেকেলে ধারনার বাইরে। যে রাত আড়াইটের সময় কারুর বেডরুমে ঢুকে পড়তে
পারে, নির্দ্বিধায় নিজের চাহিদার কথা এক অপরিচিত পুরুষের কাছে বলতে পারে, যে এক
মদমত্ত পুরুষের মত নিজের শারীরিক ক্ষমতার বড়াই করতে পারে এবং রাতে বিরেতে সমুদ্রের
ধারে ঘুরতে পারে সে যে হয় পাগল নয় এক অদ্ভুত নারী তা বুঝছি। কিন্তু সদ্য মৃত প্রিয় বন্ধুর প্রেমিকার সাথে ঘনিষ্ঠ
হওয়ার মানসিকতা আমার নেই, অন্তত আপাতত। বোকার মত হাসলাম নিঃশব্দে। আমি হতভম্ব, জুবুথুবু।
‘হাসছ যে?
এস না।’ আমার কব্জি
ছাড়িয়ে হাতটা ওপর দিকে উঠল, টান বাড়ল।
‘কি হল?
তোমার কি আমায় ভাল লাগছে না?’ ওর গলায় বিরক্তি।
না মানে এটা
তো ঠিক না রেবতী। শুভ্র আমার বন্ধু। এটা আমি করতে পারব না। তাছাড়া তুমিই বা এটা
বলছ কি করে! তোমারই তো খারাপ লাগার কথা।
খারাপ লাগবে
কেন? এস। বন্ধু তো কি হয়েছে?
না, না। এটা
করা যায় না। এটা অন্যায়। তুমি আমাদের সম্পর্ক টা বুঝতে পারছ না।
উফ! কিসের
অন্যায়? আমি কিচ্ছু জানিনা। এস। আরও জোরে টান।অস্বাভাবিক টান।
এ কি অসভ্য
মেয়ে রে বাবা! বেশ বিরক্ত হলাম, তবে আমার জোর যে খাটবে না সেটা বুঝতে পারছিলাম।
একটা ন্যাকা নাকি ভিতু গলায় না বলতে যাচ্ছিলাম আবার হ্যাঁচকা টানে গিয়ে একদম ওর গায়ের
ওপর পড়লাম। শরীরে শিহরণ হল; জীবনে প্রথম কোন যুবতীর শরীরের ছোঁয়া পেলাম। আমার গালে ওর নরম,
আঠাল, ভেজা ভেজা গাল লেগে গেল। কেমন যেন একটা মশলার গন্ধ ওর চুলে। পিঠের মাঝখান
দিয়ে শিরশির ভাব হল। হটাৎ করে কেমন ভাল লেগে গেল। না বলতে আর ইচ্ছে করছে না। দানবীয়
শক্তিতে আমায় টেনে নিল বুকের মধ্যে। আমি কিছু করার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় নিয়ে ফেলল।
আমার জীবনে এযাবৎ যৌনতার কোন ভূমিকা ছিলনা বললেই চলে। আপাদমস্তক ভার্জিন। প্রকৃতি
আমাকে যাকিছু দিয়েছিল তা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছিল। আজ এই ক্ষণে এক অজানা মানবীর
দুরন্ত আহ্বান আমাকে নিমেষে আবিষ্ট করল। কেমন যেন নেশা ধরানো গন্ধ বেরচ্ছে ওর
শরীরের আনাচে কানাচে। ভাবনা, চিন্তা লোপ পেল। মূল্যবোধ, সেকেলে চিন্তা, অহঙ্কার,
বিদ্যা, প্রজ্ঞা যা কিছু ছিল সব কোথায় অন্ধকারে মিলেমিশে এলোমেলো বিছানার চাদরে
ঢাকা পড়ে গেল। আমি হেরে গেলাম শরীরের কাছে। আমি যেন সেই আমি রইলাম না। হরমোনের
তীব্র নিঃসরণে প্রবল আবেগের আবেশ ছড়িয়ে
পড়ল আমার সারা শরীরে। অস্তগামী যৌবনের যেটুকু অবশিষ্ট পেশীশক্তি ছিল ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র।
ওর পেলবতা আমার মধ্যে একটা অন্য আমার জন্ম দিল। দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার দিক
থেকে সাড়া পেয়ে ও যেন আরও দানবী হয়ে উঠল। অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। আমায়
কখনও ওর ওপরে টেনে নিচ্ছে কখনও নীচে। হুঁশে না থাকলেও এটা টের পাচ্ছিলাম আমার বেশ
হাঁসফাঁস করছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি শিখে নিলাম, বুঝে নিলাম সবকিছু। কিন্তু বেশিক্ষন থাকতে
পারলাম না। হেরে গেলাম। ছোট ছেলেদের মত। রেবতীর অট্টহাসি তে আমার লজ্জায় একশেষ। বেশ
খানিক্ষন আমি ওর গায়ে লেগে শুয়ে রইলাম চুপ করে। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে চোখ প্রায়
জুড়িয়ে এল। হয়ত চোখ লেগেই গিয়েছিল। চেতনায় এলাম রেবতীর ঠেলায়। আরেকবার। এবারে আমি ওকে সদ্য শেখা সোহাগ করে বললাম ‘আজ আর
না। খুব ক্লান্ত লাগছে। রাগ করোনা। কালকে।’ আমি ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। তাও বুঝতে পারছিলাম আকাশ ফর্সা
হয়ে এসেছিল। বলল ‘আমায় এক্ষুনি চলে যেতে হবে। তার আগে আর একটু।’ এতটুকু প্রেম বা অনুরোধের
চিহ্ন নেই গলায়। আওয়াজটা কেমন যেন ঘড়ঘড় করছিল হিংস্র জন্তুর মতো। আমার ওকে কেমন যেন
প্রেত মনে হল। বন্ধুর প্রেমিকার সাথে রাত কাটিয়ে ধরা পড়তে আমিও চাইনা। চলে গেলেই ভাল। তাই ওকে খুশি করার জন্য
তাড়াতাড়ি আবার কাজে লাগলাম। কিছুদিন আগেই অসুস্থ ছিলাম। তার ওপরে সারাটা রাতের
মানসিক আর শারীরিক ধকল। আর পারছিলাম না যুঝতে। শরীর ভেঙ্গে আসছে ক্লান্তিতে। ফলে
আশাব্যঞ্জক তৃপ্তি দিতে পারছিলাম না। ক্রমশই বেড়ে ওঠা আলোতে আমি ওর মুখ চোখ দেখতে
পারছিলাম। কি অদ্ভুত ওর দৃষ্টি। এই সময়েও তাকিয়ে আছে, পলকহীন দৃষ্টিতে। আমি যে ওকে
দেখছি সেটাই যেন দেখছে। হটাতই এক কানে তালা ধরানো বিকট জান্তব চিৎকার। তারসঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা। আমি
প্রায় ছোঁড়া হয়ে গিয়ে পড়লাম ওর পায়ের কাছে। ভেবেছিলাম আমার পারফরম্যান্সে বিরক্ত
বোধহয়। কিন্তু দেখি ও হুড়মুড় করে উঠে বসেছে খাটে আর দৃষ্টি বাইরের দিকে। আমি ওর
দৃষ্টি অনুসরন করে তাকিয়ে দেখি বাইরের অস্পষ্ট আলোতে ঘষা কাঁচে একটা বিশাল অবয়ব।
সেটা মানুষের না বলে দানবের বললেই যেন সঠিক হয়। আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাই আর কি।
‘কে ওটা?’ কাঁপা কাঁপা গলায় রেবতী কে জিজ্ঞেস করলাম। অসংলগ্ন জামা কাপড় ঠিক না
করেই রেবতী উঠে দাঁড়িয়েছে। ওকেও কিংকর্তব্য বিমূঢ় বলেই মনে হল। এক পলকের মধ্যেই
ঝড়ের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। আমিও ওকে অনুসরন করে বেরতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেলাম
অজানা বিপদের আশঙ্কায়। ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা ধুপ
করে শব্দ। আবার। এবারে বাইরে বেরলাম। আকাশে গোলাপি, বেগুনি, নীল কত রঙ। একটা আলোর
ভাব হয়ে এলেও চারপাশটা প্রায় অন্ধকারই। কেউ কোথাও নেই। নীচে তাকিয়ে দেখি সমুদ্র
অনেকটা দূরে চলে গেছে। আর তারপরেই আবছা আঁধারে চোখে পড়ল অনেক দূরে দুটো মূর্তি
ছুটে যাচ্ছে সোজা জলের দিকে।
আর চোখ
যাচ্ছে না। জলে বা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। আমি ছুটে নীচে নামলাম। এক অজানা আশঙ্কায়
শিউরে উঠলাম। হাঁটু অবধি জলে নেমে চেঁচিয়ে ডাকলাম, ‘রেবতী! কোথায় গেলে? ফিরে এস।’
সমুদ্রের গর্জনে আমার আওয়াজ কতদূর গেল জানি না। আবার দু তিন বার নাম ধরে ডাকলাম। কোনও
সাড়া শব্দ নেই। আর কিছু ভাবতে পারছিনা। আমি যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। হোটেল এ
ফিরে, ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকের দরজাটা লাগাতে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি জলের মধ্যে
কেমন যেন একটা আলোড়ন হচ্ছে। কি যেন একটা ঘুরপাক খাচ্ছে। হাঙর? এত সামনে আসে নাকি?
আমার যে মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে না বুঝতে পেরেছি। হাল্যুসিনেট করছি। কিন্তু
কিছুতেই চোখ সরাতে পারছি না। ওটা কি! এদিকে আকাশে লাল আভা না হলেও বেশ ফর্সা হয়ে
এসেছে। তাতে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি একটা বিশাল সামুদ্রিক প্রাণী জলে বড় বড় বৃত্তে
পাক খাচ্ছে। এরকম একটি দৃশ্য চোখের সামনে ঘটলে কেউ কি চোখ ফেরাতে পারবে। আমিও
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আর কাছে আসতে পারবেনা সেটা।
অসাধারণ।
ReplyDelete