জালিয়ানওয়ালার
বাঘ
দীর্ঘক্ষণ
পর ধীরে ধীরে চোখটা একটু খুলল সুখ্বিন্দরের। অর্ধেক খোলা চোখে সতর্ক ও ভয়াল
দৃষ্টি তার। কতক্ষণ যে এরকম মড়ার মত পড়েছিল, সে নিজেই জানে না। সময়ের সব হিসেব
গুলিয়ে গেছে। শুধু এইটুকু মনে আছে, একটা গুলি সজোরে এসে তার ডান কাঁধটা ছুঁয়ে
বেরিয়ে গিয়েছিল আর সে সজোরে ছিট্কে পড়েছিল একটা গাছের গোড়ায়। মাথাটা ধড়াম করে
গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল গাছের নীচের সিমেন্টের বেদিতে। ব্যস, তারপর সব অন্ধকার। আর
কিছুই মনে নেই সুখির। এখন জ্ঞানটা ফিরতে ধীরে ধীরে সব মনে পড়তে লাগল তার। সুখি
মাথাটা একটু তুলল। যা দেখল, স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। তীব্র আতংক, যন্ত্রণা আর হতাশায়
চোখ দুটো আপনা থেকেই আবার বুজে এল।
“ফায়ার’।
অর্ডারটা দিলেন জেনারেল ডায়ার। সমস্ত পুলিশ, প্রায় পঞ্চাশ জন ছিল ওরা সেদিন
বাহিনীটাতে, সবার হাতে গর্জে উঠল লি-এনফিল্ড রাইফেল। পাশবিক উন্মত্ততায়। সে
উন্মাদনা এমনই যে ভারতীয় পুলিশ বা সেনা যেন ভুলেই গিয়েছিল আসলে তারা নিজের দেশের
লোককেই মারছে। পাশবিক উল্লাসে, চিৎকারে সেদিন ফেটে পড়ছিল ডায়ার আর তার পুলিশ।
বাগানের পাঁচটা গেটই আটকে দিয়েছিল তারা যাতে কেউই পালাতে না পারে। তাই পালিয়ে গিয়ে
বাঁচার কোন পথ ছিল না। সাক্ষাৎ মৃত্যু নেমে এসেছিল নির্বিচারে, নির্মমভাবে।
এবছর গম
আর সর্ষে চাষটা অনেক কষ্ট করে ভালো করে করেছিল সুখি। ওর বৌ গুরমিন্দর কৌর আর
ছেলে-মেয়েটাও চাষের কাজে সাহায্য করেছে খুব। অমৃতসর আর তরণ-তারণ-সাহিবের বড় বড়
হাটগুলোতে ফসলের মান্ডিতে বিক্রি করলে দুটো পয়সা আসে ঘরে। আশেপাশের সমস্ত
গ্রামগুলো থেকে বিরাট বিরাট ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে গরুর গাড়িতে করে চাষীরা তাদের ফসল
নিয়ে যায়। সুখিও যায় একসাথেই। ওর নিজের গরুর-গাড়ি নেই। গ্রামে কারো না কারো সাথে
জুড়ে যায়। কিন্তু ইংরেজ সরকারের এতরকম ট্যাক্স আর খাজনার জুলুম যে অনেকটা টাকা তো
ট্যাক্সবাবুদের দিতেই চলে যায়। তবু মানুষকে মান্ডিতে যেতেই হয়। নাহলে অত অত ফসল
বেচবে কি করে? ওখানে কারখানাগুলো থেকে ম্যানেজারেরা আসে, বিরাট বিরাট ট্রাকে করে
গম আর সর্ষে নিয়ে চলে যায়। সুখ্বিন্দরের এবছর সব দিয়ে-থুয়েও কিছুটা টাকা রোজগার
হয়েছে। সে প্রথমেই বউয়ের জন্য কানের দুল কিনল আর মেয়েটার জন্য পায়েল। ঘরে ফিরতে না
ফিরতে ছেলেটা বায়না জুড়ল তার এবার নতুন ডিজাইনের জামা চাই আর সঙ্গে একটা নতুন
পাগড়ি, তাতে ক্লিপ। সুখি আর তার বউ ঠিক করল সামনের রবিবার তারা স্বর্ণমন্দিরের
পাশের মাঠে যে সাপ্তাহিক হাট বসে, সেখানে বাজার করতে যাবে। সকাল সকাল মন্দিরের
লঙ্গরখানায় গিয়ে রান্নাঘরে কাজের সেবা দিয়ে ওখানেই দুটি খেয়ে নিয়ে বিকেলের দিকে
বাজার করে বাড়ি ফিরবে। এপ্রিলের ১৩ তারিখ আর বেশীদিন নেই। বৈশাখী তো চলেই এল। হাটে
খুব ভিড় হবে।
সেদিন
সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। অবশ্য দু-তিন দিন আগে থেকেই বৈশাখীর প্রস্তুতি শুরু হয়ে
গেছে। প্রদীপ মোমবাতি সব কেনা হয়ে গেছে। সুখ্বিন্দর নিজেই একা হাতে পাঁচিলগুলোতে
চুন রং করেছে। অবশ্য বউটাও হাত লাগিয়েছিল। আজ সকাল থেকেই বার-তিনেক লস্যি করা হয়ে
গেছে গুরমিন্দরের। পাড়ার লোকজন সব বৈশাখী-বধাই দিতে আসছে। ওরা নিজেরাও অন্যের বাড়ি
যাবে। এই লস্যিটুকু আর বাড়িতে তৈরি দুটো মিষ্টি, এইটুকু না করতে পারলে মানুষগুলোর
খাতির করবে কি করে? এর বেশী আর কিছু তো করতেও পারে না ওরা। আর সুখিটাও হয়েছে
তেমনি। নামেও সুখি, স্বভাবেও সুখি। শহরে কাজে গেলে দুটো বাড়তি পয়সা আসে। না, অত
পয়সা নিয়ে কি হবে, এই বেশ সবাই মিলে শান্তিতে আছি, এই ভালো। শুধু এই ইংরেজ সরকারটা
বিদায় হলে বাঁচি। গান্ধীজী বলেছেন, আর বেশিদিন নয়। এবার ওরা যেতে বাধ্য হবে।
আলোচনা চলছে। বাড়িতে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ওদের গলিটায় গুরুদ্বার থেকে
কীর্তনের দলটা এসে পৌঁছল। অনেক মানুষ। সকলে মিলে গুরু নানকের নামগান করছে।
সুখবিন্দরের ছেলে-মেয়েটাও গানের দলটাতে মিশে গেল। ভিড়ের মধ্যে থেকে সুখবিন্দরের
ছোটবেলার বন্ধু করণবীর সুখিকে ডাকতে এল নাচতে নাচতে। সত্যি কথা বলতে সুখি তার এই
বন্ধুটিকে আজকাল খুব একটা পছন্দ করে না। বরাবরই ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে। পরিবারের
কোন খেয়াল নেই। কোথায় কোথায় মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। অর্ধেক দিন রাতে বাড়িই ফেরে না।
সুখি কানাঘুষো শুনেছে, ওর সঙ্গে স্বদেশীদের যোগাযোগ আছে। করণ দুধের ব্যবসার আড়ালে
দুধের ক্যানগুলোতে বোমা আর বন্দুক এদিক ওদিক পৌঁছে দেয়। পুলিশের নজরে আছে। কোনদিন
ধরা পড়লে কি যে হবে। আর ওর বউটাও সেরকম। বউটাও নিশ্চয় সব জানে। করণের কাজগুলো
সমর্থন করে। এমন নয় যে সুখবিন্দর স্বাধীনতা চায় না। সেও চায়, এই ইংরেজগুলো বিদায়
হোক। কিন্তু সে বিশ্বাস করে গান্ধীজীর মতটাই ঠিক। যদি আলোচনা করেই সমস্যার সমাধান
হয়ে যায়, তাহলে আর গোলাগুলি-বোমা-বন্দুকের দরকার কি? সুখির কাছ থেকে খুব একটা সাড়া
না পেয়ে করণ এগিয়ে গেল।
দুপুর
দুপুর খাওয়াদাওয়া হয়ে যাবার পরই পাড়ার, গ্রামের যত লোক, সবাই জালিয়ানওয়ালা বাগের
দিকে যাত্রা শুরু করল। যদিও এটা বৈশাখীর জমায়েত, কিন্তু চারিদিক থমথমে আর ভিতরে
ভিতরে উত্তপ্ত হয়ে আছে। জাতীয় দলের দুজন নেতা সত্যপাল আর সইফুদ্দিন কিচলুকে ইংরেজ
সরকার গ্রেপ্তার করেছে। দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দিয়েছে বা পাঠাবে বলে খবর আছে। তাই ঠিক
হয়েছে এইদিন জালিয়ানওয়ালা বাগে বৈশাখীর সাথে সাথে একটা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভা
হবে। কীর্তণ আর গ্রন্থসাহিব পাঠ যেমন হয়, তেমনই হবে। কিন্তু তার সাথে সাথে
প্রতিবাদ জমায়েতও হবে। কিন্তু কড়া নির্দেশ আছে, কেউ কোন অস্ত্র নিয়ে যেতে পারবে
না। সব শেষে ওখানেই খাওয়া হবে। সুখবিন্দরের ছেলেটা ওখানে সবাইকে জল পরিবেশনের কাজ
করবে বলে এখন থেকে লাফাচ্ছে।
সবই ঠিক
চলছিল। হঠাৎ ওরা দেখলো হুড়মুড় করে পুলিশ বাগিচাটাতে ঢুকে পড়ল। ঘিরে ফেলল চারপাশ
থেকে। এমনকি পাঁচটা গেটেই বন্দুকধারী পুলিশ দাঁড়িয়ে গেল যাতে গেটগুলো দিয়ে কেউ
বেরোতে না পারে। তারপর নির্বিচারে গুলি চালাতে লাগল। বাচ্চা-বুড়ো-মহিলা কোনকিছু
বাছবিচার নেই। যে যেদিকে পারল ছোটাছুটি করতে লাগল। চিৎকার আর আর্তনাদে ভরে গেল
চারপাশ। প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ তো হবেই, কিন্তু পালাবে কোথায়? পালাবার পথ নেই।
একের পর এক লুটিয়ে পড়তে লাগল। সুখবিন্দর জীবনে কখনো সত্যিকারের বন্দুক-গুলি এসব
দেখেনি, গুলি চলা আর এইভাবে চোখের সামনে একদম কাছের মানুষগুলোকে মরতে দেখা তো
দূরের কথা। প্রথমেই তার মনে পড়ল মেয়েটা আর ছেলেটার কথা। একটু আগেই তো এখানেই
খেলছিল। খুব দ্রুত ওদেরকে খুঁজে বার করা দরকার। আর গুরমিন্দরটাই বা গেল কোথায়? সে
যে বলে গেল কীর্তন গানের আসরে যাচ্ছে, তারপর থেকে সুখি আর তার বউকে দেখেনি।
সুখবিন্দর ওদের নাম করে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে আতংকে দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগল। আর
এরকমই ছুটতে ছুটতে তার ডান কাঁধটায় বিরাট জোরে একটা কিছু ধাক্কা দিল। গরম হয়ে গেল
জায়গাটা। আর সে ছিট্কে পড়ল। ব্যস, আর কিছু মনে নেই তার।
শ্মশানের
নীরবতা নেমে এসেছে গোটা বাগানটায়। সুখবিন্দর বাঁ হাতটার ওপর ভর দিয়ে একটু সোজা হল।
মাথার পিছন দিকটায় অসহ্য যন্ত্রণা। ডান হাতটা অবশ হয়ে আছে। আস্তে আস্তে সে
চারিদিকে দেখল। শুধু লাশ আর লাশ। কারো মাথাটা ফাঁক হয়ে গেছে, ঘিলুটা বেরিয়ে এসেছে।
কারো চোখ উপড়ে এসেছে, কারো চোখ খোলা, আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার শুয়ে থাকার ধরনগুলোও
বিভিন্ন প্রকার। এমনকি একে অন্যের ওপরেও পড়ে আছে। কিন্তু এখানে শুয়ে থাকা
প্রত্যেকেই আজ মৃতদেহ। তাদের এই ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না। আস্তে আস্তে এগোতে শুরু
করল সুখি। কিছুটা দূরেই খুঁজে পেল মেয়েটার দেহ। দু-হাতে তখনও দুটো চুনরি ধরা আছে।
নাচছিল বোধহয়। তার আর একটু দূরে ছেলেটা। ওর বউয়ের কোলের ভেতর পড়ে আছে। বোঝা
যাচ্ছে, গুরমিন্দর কৌর বুকের মধ্যে জাপটে ধরে একটা শেষ চেষ্টা করেছিল ছেলেটাকে
বাঁচাবার। হায়! গুলির ক্ষমতা সম্মন্ধে কোন ধারনাই ছিল না বেচারার। মা ছেলের মাথা
ফুঁড়ে দিয়ে গুলিটা বেরিয়ে গেছে। নিংড়োলে রক্ত পড়বে, এত রক্ত বেরিয়ে লেগে আছে ওর
সালওয়ারটাতে। চোখ দুটো বিস্ফারিত খোলা। সুখবিন্দর বউয়ের চোখ দুটো পরম মমতায় বন্ধ
করে দিল। ও অবাক হল, চারিদিকে এত লাশ, নিজের বউ-ছেলে-মেয়ের মৃতদেহ দেখেও চোখে এক
ফোঁটা জল আসছে না। এমনকি নিজের দেহের তীব্র যন্ত্রণাগুলোও তেমন কষ্ট দিচ্ছে না আর।
শুধু মাথার ভেতরটা আগুনের মত জ্বলছে। দপ্ দপ্ করছে। সুখি বেরিয়ে এল বাগান থেকে।
ততক্ষণে মোটামুটি আঁধার হয়ে এসেছে। ও গ্রামের রাস্তাটা ধরল না, ক্ষেতের দিকে মাঠ
বরাবর চলতে লাগল। চলল বটে, কিন্তু কোথায় যাছে, জানে না। শুধু ঝোঁকের বশে হাঁটতে
লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা অনেক পুরোনো ভাঙ্গাচোরা গুরুদ্বারের কাছে এসে
পৌঁছল। বোঝাই যাচ্ছে এটা আর ব্যবহার হয় না। আর ঠিক তার উল্টোদিকে একটা ততোধিক
পূরোনো বাড়ি। প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। কেউ থাকার প্রশ্নই আসে না। পরিত্যক্ত। কিন্তু
সুখির কেন যেন মনে হল ভেতরে লোক আছে। ও এগিয়ে গেল, কান খাড়া করে। কেউ কথা বলছে এবং
সে একা নেই। কারো সাথে কথা বলছে। সুখি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। হঠাৎ পিছন থেকে
সুখির কাঁধে কেউ হাত রাখে। সুখি চমকে ওঠে, করণবীর!
-- চল্,
অন্দর চল্।
সুখি
ভিতরে ঢুকলে করনবীর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণে সুখি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।
করন আর তার সঙ্গীসাথীরা কিচ্ছু বলে না, চুপ করে অপেক্ষা করে। কিছু পরে সুখবিন্দরের
কান্নার দমকটা একটু কমে এলে একজন লম্বা মানুষ অন্য একটা ঘর থেকে যেন অন্ধকার ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসে। সুখি তাঁকে চেনে না। তিনি এসে কাঁধদুটো ধরেন সুখির। মুখটা কুঁকড়ে যায় সুখির,
এতক্ষণে যেন খেয়াল হয় তার কাঁধের যন্ত্রনাটা। সুখির হাতে একটা বন্দুক তুলে দেন
তিনি। বজ্রগম্ভীর, দৃঢ় কন্ঠে কথা বলতে শুরু করেন। সুখি সব ব্যাথা ভুলে মোহিত হয়ে
শুনতে থাকে। লোকটার কন্ঠস্বরে যেন যাদু আছে, একটা অদ্ভুত টান আছে।
--“থানায়
যাও। কিছু বোমা নিয়ে যাও। এক ভি পুলিশ বচ্না নেহি চাহিয়ে। যব তক্ সব খতম না হো
যায়ে, গোলি চালাতে রহনা। অউর কাম খতম করে সবাই বিভিন্ন দিকে চলে যাবে। একসাথে
থাকবে না। আমার সাথে এরপর কবে দেখা হবে, আমি নিজেই জানাবো। সবকুছ তো সমঝা দিয়া। আব
যাও। বোলে সো নিহাল”।