অগ্নিপ্রভা
ওই যে
মেয়েটা। সাইকেলের প্যাডেল থেকে সদ্য পা রাখল মাটিতে। বাড়ির দরজার সামনে। দরদর ঘাম
গড়াচ্ছে। কপাল, গাল থেকে। চোখে নোনা ঘাম ঢুকে যাওয়ায় জ্বালা করছে। ও স্বর্নপ্রভা
সরকার।
এখন বেলা
একটা একুশ। ভাদ্র মাসের সাতাশ তারিখের চটকা রোদ। তাপমাত্রা সাঁইত্রিশ ডিগ্রি
সেলসিয়াস। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা সাতাত্তর থেকে আশির আশেপাশে। বেশ কিছুদিন
বৃষ্টির দেখা নেই। ডিভিসির ক্যানেলও ভাঁড়ে মা ভবানী। মাঠময় ধান জমি শুকুচ্ছে জলের
অভাবে। ভরা পেটে ধান গাছেরা প্রচুর জল টানে এ সময়ে। রোদ থেকে মিহি সাদা ওড়নার মতো
হলকা, যা সাধারণত বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসের দুপুরে দেখা যায়, তেমন বয়ে যাচ্ছে। হাঁসপাঁস
ঘামে ভেজা চুড়িদার গাময় লেপ্টে গেছে। ডবডবে ওই ভিজে ওড়না দিয়েই কপালের ঘাম মোছে।
চোখের জ্বালা কমাবার চেষ্টায়।
ওকে রোজই গাঁয়ের বাইরে বেরুতে হয় পড়াতে। ইংলিশ মিডিয়াম নার্সারি স্কুলের সকালে ক্লাস।
টাইম অ্যাডজাস্ট করতে কয়েকটা ব্যাচ এবং স্পেশাল বেলা এগারোটা থেকে একটা অব্দি
পাড়ায়। গাঁয়ের মেয়ে স্বর্ণপ্রভার কাছে ছেলে-মেয়েদের পড়তে পাঠাতে বেশির ভাগ
অভিভাবকদের অনীহা। এছাড়া স্বর্ণপ্রভা কেবল স্নাতক। যদিও ডিস্টিংশন ছিল। শিক্ষাগত
কেরিয়ারে ডিস্টিংশনেরও যে বাড়তি মর্যাদা তা গ্রাম্য মানুষের বোধ-বুদ্ধিতে ধরা পড়েনা। কাজেই গুরুত্ব পায়নি স্বর্ণপ্রভা সরকার।
সংসার চালাত উপায় করতে ভিন্ন গাঁয়ে বেড়িয়ে
পড়তে হয়েছে অগত্যা। স্বর্ণপ্রভার গাঁ থেকে পূর্ব দিকে এক কিলোমিটার পর
দক্ষিণ-উত্তর বরাবর বড় পিচ ঢালা রাস্তা। দক্ষিণে তারকেশ্বর, কলকাতা। উত্তরে
বর্ধমান শহর। এই বাস চলাচলের বড় রাস্তার পাশে ছোট-বড় নানা গাঁ।
সপ্তাহরে একদিন বাদদিলে, ছ’দিনই যেত হয়
কোনো না কোনও গাঁয়ে। যত্ন ও আন্তরিকতার নার্সারি থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত সব
সাবজেক্ট পড়ায় স্বর্ণপ্রভা। প্রথম প্রথম ছাত্র-ছাত্রী পায়নি তেমনভাবে। ক্রমে নাম
যশ বাড়তে বাড়তে এখন নানা গাঁয়ের বহু ছেলে-মেয়ের মিস, ম্যাডাম ম্যাম, আন্টি ও । সেই
সব গাঁয়ের মানুষজন সম্মান দিয়ে দিদিমনি ডাকে। এই পরিচয়ে বেশ কমফর্ট স্বর্ণপ্রভা।
মেহনত করে ঘর্মক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেও
এক্ষুনি বাথরুমে চুড়িদার বদলে স্নান করে ঘরে পাখা চালিয়ে দিয়ে দুদণ্ড বসে পারবেনা
ঠান্ডা হতে। ভিজে কাপড় কোনক্রমে ছেড়ে বৃদ্ধা অসুস্থ মাকে স্নান করাবে ও। শুকনো
মুড়ি বা বিস্কুট যা হোক অল্প কিছু মায়ের মুখে দিয়ে, ওষুধ খাওয়াবে। দুপুরের ওষুধ।
ঘড়ি ধরে দেড়টার মধ্যে এরপর ভাত বসাবে মা-বেটির। ভাতের সঙ্গে আলু সিদ্ধ ছাড়া, ডাল ও
একটা যা হোক তরকারি বানাবে। খেতে বসবে প্রায় তিনটেয়। আসন পেতে মাকে নিয়ে খেতে
বসলেই ভালো লাগার অনুভবে হারিয়ে যায় রোদের ঝাঁঝ, গরমের তীব্রতা। কিছুক্ষণ আগের
কষ্টটা গ্রাহ্যের বাইরে চলে যায় নিমেষে।
রোজ রোজ সাইকেল নিয়ে এ গাঁ সে গাঁ ঘোরাঘুরি। কয়েক কিলোমিটার জার্নি প্রতিদিন।
স্বর্ণপ্রভার ইচ্ছা করে একটা স্কুটি কেনার। বাই-সাইকেলে প্যাডেল করে করে নিত্য অত
রাস্তা যাতায়াতে শক্তিক্ষয় হয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। কিন্তু ওর পরিবারের অর্থনৈতিক জোর
নেই। রোদের কড়া তেজ রুখতে আছে রোদ চশমা। তাও দেখার চশমার সঙ্গে ফটোক্রমোটিক করে
নেওয়া। স্টাইল বা বিলাসিতা বলা যাবে না কোনওভাবে। সাধারণ সস্তা ফ্রেম।
এখন মাঝে মাঝে বা নিয়মিত বিউটি পার্লারে গিয়ে ভ্রপ্লাক, হেয়ার স্পা, মুখ
ম্যাসেজ, বডি স্পা, ফেসিয়াল, চুল বাঁধা ও আরও কত কি করায় গাঁয়ের মেয়ে বউরা। তাদের
বেশ সুন্দর দেখায়। ওকেও নিশ্চয় ভালো লাগবে এসব করলে। কিন্তু মায়ের দামি দামি
রোজকার কতরকম ওষুধ, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে রুটিন চেকআপের ফিজ। এরপর সংসারের
খাওয়া-দাওয়া, একান্ত প্রয়োজনীয় খরচ জোগানোর পর হাতে টাকা থাকে না অতিরিক্ত। আছে
কয়েক সেট চুড়িদবর ছাড় তাও কমদামি। ও কলেজ যেত শাড়ি পড়ে। শহরের মেয়েরা তখনি সালোয়ার
কামিজ শুরু করে দিলেও স্বর্ণপ্রভার মতো গাঁয়ের মেয়েরা পরেনি ও পোষাক।
এখন বাইরে
কি ঘরে সব সময় চুড়িদার পরে থাকে স্বর্ণপ্রভা। দূরে কোথাও কোনও প্রয়োজনে গেলে
বিনুনি করে চুল বাঁধে। নিত্যকার টিউশনি পড়াতে সেই এলো খোঁপাই। ওর হাতে এখনো
স্মার্টফোন ওঠেনি। কবেকার ছোট সাইজের সাদা-কালো মোবাইল। কথা বলার সঙ্গে মেসেজ হয়
বড়জোর। হাল আমলের সোশাল নেটোয়ার্কিংয়ে প্রবেশ করেনি ও। ওই র-ঠ সেটে ইন্টারনেট
সংযোগের প্রভিশান নেই।
স্বর্ণপ্রভার মতো শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত
এমন কী লেখাপড়া না জানা সাধারণ এবং টালি, খরের ছাউনির ভাঙা ঘরে বসবাস করা মেয়েদের
কাছেও রঙিন, হাতের তালুজোড়া বড় ফোন। তা দিয়ে তারাও কেমন আন্তর্জালে খটাখট লাইক, কমেন্ট, শেয়ারভূক্ত হয়ে জীবন
অতিবাহিত করছে।
আলো ঝলমলে ঝাঁ চকচকে বাড়ির বাসিন্দাদের
সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এমন অন্তসারশূন্য আনন্দে বেহিসেবী ভাসতে পারে না স্বর্ণপ্রভা।
ওর অভাব আছে। অভাববোধ আরও প্রকট। অথচ আপশোষ নেই। হতাশাকে ওর চতুঙ্গীয় ঘেঁষতে দেয় না। উল্টোপাল্টা খরচ ওর ধাতে সয়না। অনটন আছে এমন কথা ওর মুখে
কেউ কোনওদিন শোনেনি। থাকার মধ্যে আছে গাঁয়ের
বাবলু ভাইয়ের ফুচকার প্রতি লোভ। ও যখন পড়িয়ে বাড়ি ফেরে, ওর বাবলুভাই তখন গাড়িটা
নিয়ে কোনও ইস্কুলের দিকে যায়। টিফিন টাইমে খদ্দের ধরার জন্যে। মাঝে মাঝেই রাস্তায়
মুখোমুখি। স্বর্ণ প্রভার তখন মাথার ঠিক থাকে না। খরচ কমানোর চিন্তাটা উধাও হয়ে
যায়। সিদ্ধ আলুতে পেঁয়াজ, গোলমোরিচ,
লঙ্কা, ধনেপাতা সহযোগে দুর্দান্ত বানানো চার্ট দিয়ে, তেঁতুল গোলায় ডুবিয়ে
নোনতা ফুচকা গোপাগপ ক’টা মুখে পুড়ে দেয়। কাস্টমার পটানোর কায়দায়, হাসিহাসি মুখে
বাবলু বলে, “সন্নদির কাছে বউনি হলে একগাড়ি ফুচকা সব দুপরেই সাবার হয়ে যাবে।”
এমন কথায় স্বর্ণপ্রভা খুশি হয় তখন।
বলে “তাই?”
“হ্যাঁ গো সন্নদি”
যত্ন করে
আরো দু’টো ফুচকা টপাটপ তেঁতুল গোলায় ডুবিয়ে পুর ভরে স্বর্ণপ্রভার হাতে তুলে দেয়
বাবলু। বলে, “এ দুটোর পয়সা নেবনি। পয়মন্ত খদ্দেরকে খুশি হয়ে খেতে দিলাম।”
এরপর আর জোড়াজুড়ি করেনি স্বর্ণপ্রভা।
বাবলু আনন্দে তার তিন চাকার টলি-ভ্যানের প্যাডেলে চাপ দিয়ে দ্রুত চলে যায় বাজার
ধরতে।
স্বর্ণপ্রভার
উচ্চতা মাঝারি। গায়ের রঙ মাঝারি। চেহারা মাঝারি। দেখতেও মাঝারি। বিয়ে করেনি। ওকে
পছন্দ করে বিয়েতে রাজি হওয়া কত পাত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছে হেলায়, ওর শর্তে রাজি না
হওয়ায়। মুগ্ধ হয়েও প্রস্থানে বাধ্য হয়েছে একাধিক পাত্র।
স্বর্ণপ্রভার
মাথাতে ঠাঁই পায় না, মায়ের বিপন্নতা। একজন সন্তানকে পেটে ধারণ করার যে ত্যাগ কোনও
কিছুর বিনিময়ে পূরণ হবার নয় তা। এছাড়া লালন-পালন করে বয়সবৃদ্ধি ঘটানো। সেই মাকে ছেড়ে শ্বশুরালয়, স্বামীর কাছে
গিয়ে থাকা, মাকে পর করে দিয়ে পরবাসী হয়ে ওঠার দ্বৈতযন্ত্রণা, মনেমনে অনুভব করে। ওর
মনে হয় এটাও স্বার্থপরতার এক অন্য রূপ। স্বর্নপ্রভার ব্যক্তি স্বত্তাই ওর
অস্তিত্ব। যা ওর কাছে অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই অদ্ভুত আস্থা প্রকাশের মধ্যে বিন্দুমাত্র
হইচই নেই। বিনীত স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে প্রতিফলিত ওর চরিত্রায়ন।
স্বর্ণপ্রভার মতো মানুষ যাঁর সন্তান তাঁর
গর্ববোধ স্বাভাবিকতার মধ্যে পড়লেও বাস্তব আসলে আসলে ঠিক ওল্টো। স্বর্ণপ্রভাই যেন
গলার কাঁটার মতো বিঁধে অস্বস্থিটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমে। হীনমন্যতায় ভুগে ভুগে
দিনে দিনে আড়ষ্ট হচ্ছিলেন স্বর্ণপ্রভার মা গীতাদেবী। মেয়ে যতই চরিত্রব্রতী হোক,
পাড়া-গাঁয়ের পরিবেশ, যেখানে ‘পর নিন্দা পর চর্চা’র স্বাভাবিক চল, সেখানে মানুষের
মনে পঁয়ত্রিশ পেরুনো মেয়ের বিয়ে না হওয়ার প্রশ্ন ওঠার প্রবণতাকে ঠেকানো যায় না। গীতাদেবীর
চেতনায় এই সারসত্যটা, মেয়েকে বোঝাতে পারেন না। আবার মেয়ের যুক্তির পাশে দাঁড়াতে না
পেরে দোটনায় দুলতে থাকেন। পড়ে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস। বিড় বিড় করে বলেন, “ভগবান আমাকে
কেন তুলে নিচ্ছেন না। আমাকে নিয়েই মেয়েটার যত ঝড়ঝাপটা। কোন অপরাধে মেয়েটাকে এতবড় শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে ঠাকুর? ঠায়
বসে বসে দেখে যেতে হচ্ছে আমাকে। এসময়ে যার শ্বশুরঘর, স্বামীর কাছে থাকার কথা, সে
সঙ্গীহীন হয়ে বুড়িটার বোঝা টেনে যাচ্ছে সমানে।”
বোলতার ছলের মতো সমাজের নানা জনের কথার আঘাত গুলো গীতাদেবীর প্রাণনাশের নয়
ঠিক, তবে মনাঘাতে মস্তিষ্ক-স্নায়ু জড়ানো শরীর অস্বাভাবিক চাপে দুমড়ে মুচড়ে অসাড়
হচ্ছিল। দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় মানসিক বিপর্যস্ত প্রতিনিয়ত। স্বর্ণপ্রভা একদিন
মায়ের মাথা থেকে পিছুটানের ভাবনাটা তাড়িয়ে দিয়ে, মনে জোর আনার জন্য বলল, “আমাকে
নিয়ে খামোখা চিন্তা করোনা তো। তোমাকে যারা আমায় নিয়ে ভাবনার কথা তুলে আদিখ্যেতা
দেখায়, তারা আসলে তোমার যন্ত্রনাটাই বাড়িয়ে দিয়ে, কৌশলে ভাল সাজতে চায়। তুমি তাদের
বলবে, সমাজের আরও বড় বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। সেগুলো নিয়ে ভাবলে দেশের অনেক
মানুষের মঙ্গল হবে। উপকার হবে তাদেরও। তোমার মেয়ে দিব্বি আছে।”
শুকনো গলায় গীতাদেবী বলেন, “এসব কথা বলে
পাড়া, পড়শি, সহবাসীদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাব শেষে?” স্বর্ণপ্রভা মাকে আব্দার মিশ্রিত
মৃদু ধমকে বলল, “নরম মাটিতেই ছেলে-মেয়ে,
বুড়ো-বুড়ি সবাই একযোগে লাফায়। লাগবেনা এই ভেবে। একদিন মুখটা খুলে দেখই না। সব্বার মুখ
বন্ধ হয়ে যাবে। আমাকে তো পাড়া, গাঁয়ের একজনও কোনও দিন প্রশ্ন করে না, যে এখনো বিয়ে
করছি না কেন?” এলাকার মানুষ ভালো করে জানে, যে কোনও মানুষের গায়ে পড়ে অবান্তর
যুক্তিহীন কথা মোটে সহ্য করবে না স্বর্ণপ্রভা। যুতসই একটা উত্তর তার মুখে যোগানই
থাকে সবসময়। এর উপর আক্রমণ হলে তো কথা নেই। বিরুদ্ধতার জন্য ওর কন্ঠস্বর বরাবর
অকস্পিত। গাঁয়ের মানুষের এতদিন ধরে জানা ছিল, ছেলেরাই যুক্তি দিয়ে তর্কযুদ্ধে যুঝতে
না পেরে গুণ্ডামি পর্যন্ত করে। বোমা-পিস্তল পর্যন্ত বের করে কথায় কথায়। স্বর্ণপ্রভার কথাতেই এমন যুদ্ধংদেহী রূপ ধীরে ধীরে
সমর্থ হয় সমীহ আদায়ে। ওর কন্ঠের এক ধরনের স্নিগ্ধতা সাধারণ মানুষের অনুভবে ধরা পড়ে সহজে। তাতেই ওকে অপরাপরের থেকে পৃথক ভাবতে
থাকে ধীরে ধীরে।
এমন সরল ও ব্যক্তিত্বময়ী হওয়ায়
স্বর্ণপ্রভাকে দলীয় কাজে লাগাতে আগ্রহী হয় পলিটিক্সের লোকেরা। ‘নায়ক’ হয়ে ওঠা চলতি
দল এবং ‘নায়ক’ হতে চাওয়ার চেষ্টায় থাকা উভয় পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছিলো
পঞ্চায়েতে প্রার্থী হওয়ার। এমন স্বচ্ছ ভাবমূর্তী সম্পন্ন মহিলাকে রাজি করাতে পারলে
সে দলের বাজিমাত। স্বর্ণপ্রভা কার্যকরি করতে দেয়নি কোনও দলেরই গোপন কৌশলকে। ও
পরিষ্কার বুঝেছে। এখনকার মনহীন রাজনীতি শুধু ক্ষমতার কক্ষপথে আবর্তিত হয়ে কেবল
আধিপত্যকে আরও নিশ্চিদ্র করা। নাগরিকের মন জয়কে দূরে সরিয়ে, ভয় দেখিয়েই যে শাসনের
মূল লক্ষ্য। দেশ, সমাজসেবা এমন মহামূল্যবান কথার উপলব্ধি এদের ধারে কাছে নেই।
গীতাদেবী ভাবেন, তার উপযুক্ত বড় সন্তান
দায়িত্ব না নিয়ে, কোনও খোঁজ খবর পর্যন্ত না নিয়ে শহরে গিয়ে নিশ্চিন্তে সংসার করছে।
আর গড় থেকে বেড়িয়ে এসে তার কন্যা কী অবলীয়ায় গর্ভধারিনীর যত্ন-আত্তি করে চলেছে।
রোগ-জ্বালা সব সামলাচ্ছে হাসিমুখে। ভুলেও কোনোদিন বড় দাদার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন
স্বার্থপরতার কথা আলোচনায় তোলেনি। স্বর্ণপ্রভাকে নিয়ে ভাবতে বসলে এখন মায়ের উদ্বোগেকুল
মুখে আলা খেলে যায়। বাকি জীবনটা মা মেয়েতে কাটিয়ে দেবার নিশ্চয়তা পান গীতাদেবী।
অথচ এই স্বর্ণপ্রভার উপর কত অবিচারই না
হয়েছে জন্মের পর থেকে। এখনও স্বর্ণপ্রভার স্পষ্ট মনে পড়ে, পাড়ার বড়রা ওকে কোনোদিন
স্বর্ণপ্রভা তো দূরের কথা, স্বর্ণ বলেও ডাকেনি। ‘সনো’ বলতো অবহেলায়। আর সমবয়েসিরা
রাগাত ‘শনি’ বলে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত যখন তখন। কাঁদতে কাঁদতে এসে মাকে জানালে,
মা বলতেন, “মেয়েদের এমন সহ্য করতে হয়। রাগ করতে নেই। শ্বশুর ঘরে গেলে আরও অনেক
কষ্ট, মুখ ঝামটা সয়ে যেতে হবে।” অন্যায় অত্যাচার করা ছেলেদের উদ্দেশ্যে একদিনও মুখ
খোলেননি ওর মা। অন্যদিকে ওর দাদা প্রভাতাংশুকে যদি কেউ ভুল করেও প্রভাত বলে ফেলত,
তক্ষুণি সব কাজ ফেলে, মা দৌড়ে গিয়ে তাদেরকে ট্যাঁশ-ট্যাঁশ করে কত কথা শুনিয়ে
আসতেন। স্বর্ণপ্রভার বাবা অফিস থেকে ফিরলে দাদাকে নিয়ে যত পরিকল্পনা শুরু হতো
কর্তা-গিন্নির। দাদার পড়াশোনার একাধিক টিউশনির শিক্ষকদের সঙ্গে কোথায় কোন্ ঘাটতি
তা বিশদে আলোচনা করতেন বাবা। দাদার নতুন নতুন পোশাক, কতরকমের স্যান্ডেল, শু। মেয়ের দিকে কোনও নজর ছিল না।
না মা, না বাবার।
স্বর্ণপ্রভার লেখাপড়া যতদূর এগিয়েছে তা ওর নিজের চেষ্টায়। স্নেহ, ভালোবাসা,
আদর-যত্নে এমন পক্ষপাত সাধারণত আশা করা যায় না। তবু ওটা ছিল প্রকটভাবে।
স্বর্ণপ্রভার কাছে এখন পরিস্কার, জেন্ডারগত ভাবনা থেকেই দাদার প্রতি ওর বাবা-মায়ের
দুর্বলতা, প্রশ্রয় মাত্রাছাড়া ছিল। কৈশরকালে দাদার প্রতি এমন বড্ড বেশি খাতির,
হাতের তালুতে রাখা থাকে বলে, তা দেখে শুনে ওর কষ্ট হতো। গুমরে গুমরে কেঁদেছে
কতদিন। মেয়ের চোখ দিয়ে যে জল ঝড়তো, তাতে মা-বাবার কারোরই নজর দেবার প্রয়োজন বোধ
হয়নি। দাদা প্রভাতংশও অনুকূল পরিস্থিতিতে সুযোগ নিত বেশ। অহেতুক বোনকে এটা, ওটা
ফাইফরমাশ খাটাত। পান থেকে চুল খসলেই ফটাফট চড়, থাপ্পর লাগিয়ে দিত। সয়ে সয়ে ওটাকে
ওর ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে তখন স্বর্ণপ্রভা।
স্বর্ণপ্রভার বাবা কর্মরত অবস্থায় অজানা
রোগে হঠাৎ মারা গেলেন। ওর দাদা প্রভাতাংশু তখন মাস্টার্স কম্পপ্লিট করে চাকরির জন্য
চেষ্টা করছে। স্বর্ণপ্রভারও গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ। আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে
ক্ষতিপূরণের প্রতিশানে মা চাকরিতে উপযুক্ত হয়েও দাদাকে বাবার চাকুরির প্রতিষ্ঠানে
যোগদানে সম্মতি দেন। অফিসের অভিজ্ঞ কয়েকজন এবং পাড়ার লোক মাকে স্বর্ণপ্রভার কথা
ভাবতে বললেও, মা সেকথায় কর্ণপাত করেননি একটুও। ভেবে ছিলেন, মাকে তার ছেলেই দেখবে।
বিয়ের পরে মেয়ে তো শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে!
চরম বিষয়ী
স্বর্ণপ্রভার দাদা প্রভাতাংশু চাকরিতে যোগদানের দু’বছরের মাথায় মাকে না জানিয়ে
বিয়ে করে শহরবাসী হয়ে যায়। নিজের স্বার্থসিদ্ধি হয়ে যেতে বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ
রাখেনি দাদা। দূর দেশে এমন কি বিদেশে থেকেও নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে অত্যাধুনিক ফোনের
মাধ্যমে কথা বলে, ভিডিও কলে দেখা দিয়ে মা, বাবার প্রতি কর্তব্য পালন করে কতজন। স্বর্ণপ্রভার
দাদা মায়ের খবরটাও নেয় না। হাত তুলে দিয়েছে সেই কবে। মা অবশ্য নিজে থেকে ফোন করে
খবর নেন মাঝে মধ্যেই । বলেন, “কুপুত্র যদিও হয়, কুমাতা কখনো হয় না।”
ফোনেই সুখে থাকতে আর্শীবাদ করেন। স্বর্ণপ্রভা
এতে বিরক্ত হয় না এতটুকু। বরং আগ্রহ সহকারে দাদার সুখের সংসারের খবরে কান রাখে,
মায়ের পাশে থেকে।
**********
স্কুলে যাবার সময় এক-আধদিন দেরি হয়ে যেত নীলাদ্রির। দেখত স্বর্ণপ্রভাকে।
নীলাদ্রির মটর বাইক আর স্বর্ণপ্রভার সাইকেল। মুখোমুখি হয়ে একে অপরকে পাশ করত।
ক-দিন এমন হওয়ার পর নীলাদ্রি নিশ্চিত হল, নিয়মিত ভাবে স্বর্ণপ্রভা কোথাও যায়। ভাল
লাগল নীলাদ্রির এমন দেখা হওয়াটা। এরপর
থেকে ইচ্ছা করেই দেরি করে বেরুত বাড়ি থেকে। স্বর্ণপ্রভার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে
হওয়ার অছিলায়। স্কুলে গিয়ে ম্যানেজ করত নানা অজুহাত দেখিয়ে। স্বর্ণপ্রভা বুঝতে
পেরেছে বুঝে নিয়ে নীলাদ্রি সেদিন বেশ গুছিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল স্বর্ণপ্রভাকে, কোনও
সংকোচ না রেখে। নির্মল চাউনি থেকে বিন্দু বিন্দু মুগ্ধতা বর্ষিত হয়েছে নীলদ্রির
দুটি চোখ থেকে। কোনও পুরুষের এমন দৃষ্টিটুকুর জন্য ভিতরে ভিতরে প্রতীক্ষা করেছে
স্বর্ণপ্রভা। তবু চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। আগে তো কই কারো থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি এমন
চোখের ভাষা। গলার স্বর নামিয়ে শুধু বলতে পেরেছিলো, “কী দেখেন রোজ? এমন করে?”
দ্বিগুণ
আগ্রহ নিয়ে নীলাদ্রি বলেছিল, “ফাঁকা পড়ে থাকা জমিটা শুধু মাপা হল আজ। ঢালাই দিয়ে
কংক্রীট করতে হবে ওটাকে। এবার কর্তৃপক্ষের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট জরুরি।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দিয়েই দুষ্টুমির হাসি হেসে বাইকের গতি বাড়িয়ে চলে
গিয়েছিল নীলদ্রি। শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করে চমকে উঠেছিল স্বর্ণপ্রভা। ধীরে ধীরে
মন ভেদ করে শরীরে অন্যরকম কম্পনের জন্ম হলো তৎক্ষণাত। আলোড়িত মনে সেদিন বাড়ি ফেরে
স্বর্ণপ্রভা।
আগাম কোনও
খবর না দিয়ে কয়েকদিন পর নীলাদ্রি ওর মাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে সোজা চলে গেল
স্বর্ণপ্রভাদের বাড়ি। তখন বিকেল গড়িয়েছে। নীলাদ্রির হাবভাবে মাথামুন্ডু গুলিয়ে যায়
স্বর্ণপ্রভার। মা গীতাদেবী অশক্ত শরীরে শসব্যাস্ত হয়ে ওদের ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে
বসান। বেশ ঝরঝরে লাগছে গীতাদেবীকে। মেয়েটার গতি হবে একটা। স্বর্ণপ্রভাই তার মাতৃ
হৃদয়ে ব্যথার বড় কারন। তুষের আগুন জ্বলছে মনের ভিতরে।
স্বর্ণপ্রভাকে দেখে ভাল লাগল সাধনাদেবীর।
ছেলের পছন্দ মন্দ নয়। তারিফ করতে হয়। তাদের বাড়িতে মানাবে। স্বর্ণপ্রভার মায়ের
কাছে তো নীলাদ্রি ছেলে হিসাবে সোনার চাঁদ। কপাল করলে এমন জামাই পাওয়া যায়। এ চাঁদ নিজে থেকে মাটিতে নেমে এসেছে যেন। কথা পাকাপাকি
প্রায়। কিন্তু স্বর্ণপ্রভার তোলা একটা শর্ত সেদিনের মতো বিবাহের আলোচনা বন্ধ হয়ে
গেলো মাঝ পথে। মা-ছেলের কারোর পক্ষেই এমন শর্তে সম্মত হওয়া সম্ভব হয়নি। আবার
স্বর্ণপ্রভার যুক্তিকেও অবহেলা করে অসম্মান করারও নয়। এমন দো-টানায় ফিরে এসেছিলো
নীলাদ্রি মাকে নিয়ে।
ক্ষণেকের
জন্য ফুরফুরে হালকা মনে ধাক্কা লেগে মুখ কালো হয়ে উঠলো গীতাদেবীর । মেয়ে বড় ‘জেদি’
বলে আপশোষ করতে লাগলেন সেদিনের পর থেকে। আর যত রোগ তাকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধতে থাকল
ক্রমশ।
নীলাদ্রি দুদন্ড ভুলে থাকতে পারে না স্বর্ণপ্রভাকে।
ওর গলা কোনও অভিনেত্রীর মতো সুরেলা নয়। কোকিল বা কাকাতুয়া কন্ঠীও নয়। তবে বিশেষ
বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গলা থেকে বের হওয়া কথাগুলোর বাস্তবতা নীলাদ্রির ভিতরে ঢুকে ওর
চেতনাকে ফালাফালা করে দিচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। এটাও ভাবল, যেসব মানুষের ভিতরে তেজ,
দৃঢ়তার যোগান থাকে তাদের মুখে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে মেয়েটার উপস্থিতিটাই
একেবারে অন্যরকম। হঠাৎ আত্মসমর্পণের ভাবনা মাথায় আসতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। হাসি পেল
ওর। শুরু হল অস্থিরতা। স্বর্ণর সঙ্গে দেখা
করা দরকার। তাকে ছাড়া...। তার আগে মাকে জানাতে হবে, তার এমন সিদ্ধান্ত।
সন্তানের চোখ মুখের চেহারা, মনের চঞ্চলতা
দেখেই ধরা পড়ে যায় নীলাদ্রি। ছেলের মুখ থেকে শোনার পূর্বেই, মা সাধনা দেবী বলেন,
“তুই স্বর্ণপ্রভাকেই বিয়ে কর বাবা।”
মায়ের কথায়
হতবাক নীলাদ্রি। বলল, “তুমি জানলে কী করে?”
“মাকে কিছু
লুকানো যায় না। তাই।”
“কিন্তু মা,
তোমার”-
“কোনও
কিন্তু যদি নেই আর। তার শর্তেই আমি রাজি। সবার আগে এখন জোর দেওয়া জরুরি সম্পর্কটায়।
ওইটার মধ্যে যে শেকড় সবে গজিয়েছে, ডাল-পালা মেলে বড় না হলে তা সার্থক হবে না। আমি
জানি একবার ওতে জড়িয়ে পড়লে, সব ঠিক হয়ে যাবে ধীরে
ধীরে। তা ছাড়া আমি এখনো যথেষ্ট শক্ত-সামর্থ আছি। মা বেটার সংসার দিব্বি
চালিয়ে নেব। স্বর্ণপ্রভা বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে। ও যেমন ওর মায়ের প্রতি দায়বদ্ধ তেমনি শাশুড়ির
প্রতিও কর্তব্য পালনে ত্রুটি রাখবে না। তবে তোকেও স্বর্ণপ্রভার মতো আমাকে
দেখাশোনার সাথে সাথে স্বর্ণপ্রভার পাশে থেকে তোর শাশুড়িরও দায়িত্ব সমানভাবে
ভাগাভাগি করে নিতে হবে।”
মায়ের এমন
অবস্থানে নীলাদ্রি মানসিক ধাক্কা সামলে দৃঢ় হল। বলল, “তার মানে বিয়ের পর”-
ছেলের মুখের
কথা কেড়ে নিয়ে সাধনাদেবী বললেন, “বিয়েত নিয়ম রক্ষা করে স্বর্ণপ্রভা ওর মায়ের কাছে
গিয়ে থাকবে। যেমন এখন আছে তুই সময় সময় যাবি। আবার ও আসবে নানা অনুষ্ঠান পার্বণে।
প্রয়োজনে বেয়ানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে বৌমা।”
প্রাণ
জুড়িয়ে গেল নীলাদ্রির। মায়ের মনোভাবে। অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে, “যাক বাবা! মাকে
অন্তত আর বিয়ের পর কোনও মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে না গিয়ে, প্রায় পাকাপাকিভাবে নিজের
বাড়িতে থাকবে- এমন উল্টো নিয়মটা বোঝাতে হবে না।”
এখন নীলাদ্রির মনের অবস্থা যা, ও যদি পাখি
হত, পরিযায়ী পাখির মতো, হাজার হাজার কিলোমিটার পাখা মেলে উড়ে যেত। এক্ষুনি। ওর
একান্ত পছন্দের জায়গা স্বর্ণর কাছে। কিন্তু তার আর দরকার হবে না। সামান্য পথ মোটে।
মটর বাইকেই সই। আপাতত পাখি হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফোনে ধরল স্বর্ণকে। বলল, “স্বর্ণ...”
অপর প্রান্ত
থেকে স্বর্ণপ্রভা আখরোটের চেয়েও খটখটে হাসি হেসে বলল, “আপনি আবার কোন মতলব ছকে ফোন
করেছেন?”
চরম
অস্থিরতার সঙ্গে নীলাদ্রি বলল, “স্বর্ণ, আমার কথাটা শোনো প্লিজ। ফোনটা কেটে দিও
না।”
নীলাদ্রির
আকুলতা বোধগম্য হল স্বর্ণপ্রভার। নিজে বদলে ফেলল তৎক্ষণাৎ। বলল, “কী বলতে চাইছেন? বলুন।”
“আমার মা
তোমার শর্তেই আমাদের বিয়েতে সম্মত হয়েছে। আমি দেখা শীঘ্রি করবো। শুনিয়ে রেখো
মাসিমাকে।”
“তাই করবেন।
মাকে শোনাব”
তার প্রতি
নীলাদ্রির এমন সমর্পণের ব্যাকুলতায় স্বর্ণপ্রভা ভাবল, সে কি এখনো সুন্দরি আছে?
যাকে নিয়ে কেউ এমন উতলা হতে পারে? নিমেষে নরম করল তার গলার সুর। আগ্রহ নিয়ে বলল,
“কবে আসবে তুমি। আমাদের বাড়ি?”
“কাল-ই।
স্কুল থেকে ফেরার সময়”।
মুহূর্তে
আনন্দ এলো স্বর্ণপ্রভার মনে। বলল, “তাই হবে। তোমার অপেক্ষায় থাকবো আমি”।
স্বর্ণপ্রভার
চিন্তার মধ্যে ঝড় ঢুকে ওলট-পালট করে দিতে থাকে সব। জীবনটা নিয়ে মা-বেটির বাঁধা ধরা
রাস্তায় গড়িয়ে চলেছে সে। নিজের কাছে, নিজের একান্ত প্রাধান্যটাই গৌণ হয়ে গিয়েছিল এতদিন। এবার
নীলাদ্রিকে নিয়ে জন্ম হয় কত কথার। অনেক কথার স্রোত ওর বুকের মধ্যে। আজ অব্দি যা
কাউকে বলা হয়ে ওঠেনি। এই প্রথম কোনও পুরুষ তাকে নিয়ে এমন করে ভেবেছে। এই সমাজের
বুকে বাস করে যা স্বপ্নেও ভাবেনি। ঘুম আসছিল না কিছুতে। খালি মনে পড়ছে, সেদিনের
সেই বিশেষ চাউনিটা। মনটা খালি দুলে দুলে উঠছে। উদগ্রীব হয়ে উঠল নীলাদ্রির আসার
প্রতিক্ষায়।
*********
সন্ধ্যা হয়েছে
একটু আগে। স্কুল থেকে একবার বাড়ি ঘুরে মায়ের সঙ্গে দেখা করে, ফ্রেশ হয়ে নীলাদ্রি
যখন স্বর্ণপ্রভাদের বাড়ি এল তখন রাত নামছে। তবে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারিধার।
বাড়িয়ে আশপাশের গাছগুলো হাওয়ায় সামান্ন দুলছে। স্বর্ণপ্রভা তার পোশাকে আমূল
পরিবর্তন করে, নতুন সাজে সেজেছে আজ। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ায় উৎকন্ঠিত হয়ে
জানালার পাশে বসে অপেক্ষায় প্রহর গোনে। কখন নীলাদ্রি আসবে? কী ভীষণ আগ্রহ স্বর্ণপ্রভার
। তার নীলাদ্রির জন্য।
নীলাদ্রি
আসায় মনের বিষাদ সরে গেল গীতাদেবীর। রোগযন্ত্রণাও যেন সেরে গেছে আজ। উজ্জ্বল হয়ে
ওঠে মুখ। হাসি ফুটিয়ে নীলাদ্রির উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি শেষে আমার এই জেদি, একরোখা
মেয়েটার কাছে হার মানলে বাবা?” নীলাদ্রি বলল, “মাসিমা, হার মানা নয় এটা। স্বর্ণর
যুক্তিকে অবহেলা করে ফেলে দেবার নয়। বলতে পারেন, আমার চিন্তা বলয়ের একমুখী ভাবনাকে
দূরে করে দিয়ে স্বর্ণ সক্ষম হয়েছে, আমাকে কনভিন্স করতে। আপনার মেয়ে অনেকেটাই ‘বড়’
হয়ে উঠেছে। সাধারণভাবে আমরা কেউ মেয়ে, কেউ
শুধুমাত্র পুরুষ হয়ে বাঁচি। স্বর্ণ ‘মানুষ’ পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছে। আমি সেটা
সম্মকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি বলেই, ওর সঙ্গে আমার জীবন জুড়তে আগ্রহী। আপনার মেয়ে
স্বর্ণপ্রভাতে আটকিয়ে না থেকে, তাকে ছাপিয়ে অগ্নিপ্রভা হয়ে উঠেছে। সেই উত্তাপ
লেগেছে আমার মনে। আর আপনিও সার্থক অগ্নিগর্ভা”।
হবু জামায়ের
কথায় আপ্লুত গীতাদেবীর চোখের কোণায় চিকচিক করলো মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু। কোথায়
তার রোগ! সব উধাও। স্বর্ণপ্রভা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দিকে চেয়ে আছে নীলাদ্রির দিকে।
চোখের পলক পড়ছে না।
দারুণ গল্প। আজকের দিনে অধিকাংশ পরিবারেই পুত্রসন্তানকে যে যত্ন ও সময় দিয়ে লালন করা হয়, কন্যাসন্তানকে তার সিকিভাগ গুরুত্বও দেওয়া হয় না। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুত্র জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাবা-মার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখে না। লেখক এখানে সমাজের একটা জ্বলন্ত সমস্যাকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। স্বর্ণপ্রভাকে লেখক সমাজের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে লড়াইয়ে সামিল করেছেন। বেশ সুন্দর গল্প।
ReplyDeleteOsadharon maaner golpo. Swarnaprova r choritroti mone daag kete gelo. Lekhar munsiana ke somman janai. Khub sundor uposthapona kora hoyeche golpoti.pore valo laglo.
ReplyDeleteKhub sundor lekha golpoti. Swarnoprova r choritroti k kurnish. Osadharon ek kahini upohar dieachen lekhok. Khub valo laglo.
ReplyDeletesompurno ulto pothe hata 1ti golpo thik paltanor moto. uposthapon o sundor.
ReplyDelete