জালিয়ানওয়ালাবাগ: তাপস দাস



জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ: ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি রাষ্ট্র ও তার যন্ত্র


মানব সভ্যতার ইতিহাস সবলের আস্ফালন ও দুর্বলের নিষ্পেষণ এর ইতিহাস। তার বাঁকে বাঁকে রয়েছে শোষিত সর্বহারা মানুষের কান্না ও দীর্ঘশ্বাস। শক্তির দম্ভ ও অহংকার শাসকের যুগান্তরের চরিত্র ও সম্পদ বলে বিবেচিত হয়েছে। যদিও সেই শক্তির দম্ভ ও ভার তাকে তলিয়ে দিয়েছে, হারিয়ে দিয়েছে আবহমানের কাছে। তবু শিক্ষা নেয়নি সবল, তবু শিক্ষা নেয়নি শাসক, তবু শিক্ষা নেয়নি রাষ্ট্র ও তার শাসনকারী যন্ত্র।

         আজকের দিনে এই কথাগুলো ভীষণ ভাবেই রাষ্ট্র ও তার শাসন যন্ত্রকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। কারন এই বছরই সেই নারকীয় ঘটনা যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক চিরস্থায়ী কলঙ্কের দাগ রেখে গিয়েছিল তার শতবর্ষ পূর্ণ হলো। ব্রিটিশ শাসনে পদানত ভারতবর্ষে ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সভায় জেনারেল ডায়ার এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনার হাতে সরকারি হিসেবে
৩৭৯ জন নিরস্ত্র মানুষের হত্যা হয় যা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হিসাবে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এরূপ নারকীয় ও মানবতা বিরোধী হত্যাকাণ্ড ভারতের তথাকথিত বাবু এলিট সম্প্রদায়কে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বরূপ উন্মোচন সহায়তা করেছিল। তবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভাষা সর্বাত্মক ছিল না। সমকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃত্ব এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ করেছিল বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত ভাবে। তা কখনো সর্বাত্মক ছিল না।এর পিছনে প্রধানতম কারণ হতে পারে যে ব্রিটিশ রাজ তার সমস্ত শাসন যন্ত্র ও ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ও ছোট ঘটনা প্রতিপন্ন করার জন্য। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার ও ব্যক্তি জীবনে নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা।

           আজ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ পেরিয়ে আজও কী আমরা বলবো এরূপ মানবতা বিরোধী ঘটনা যা রাষ্ট্রের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল তা ইতিহাসের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা??!!.. তাহলে আজ কাস্মিরের জনগণের উপর যা ঘটছে,আসামে NRC  নামে রাষ্ট্র ও তার শাসন যন্ত্র যা করছে, প্যালেস্টাইনের জনগণের উপর যা ঘটছে, ভিয়েতনামে যা ঘটেছিল,১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিল এ যা ঘটেছিল,বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তর যে কারণে হয়েছিল অথবা ২ হাজার বছর আগে গোলগোথার নারকীয় ঘটনাও কি তাহলে ইতিহাস এর কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে??!!...

            তা বোধহয় নয় বন্ধুরা। তাহলে প্রশ্ন জাগে এরূপ ঘটনা থেকে ইতিহাস তথা মানবজাতিকে পরিত্রাণের পথ দেখাবে কে??..কে দেখাবে আলোর সন্ধান?.. এই বিরাট প্রশ্নের মহত্তর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ঐ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই।

          এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ থেকে সমকালীন রাজনীতি যখন শত যোজন দূরে তখনই মানবতার অবক্ষয় ও হত্যা দৃশ্যে শিহরিত ও রক্তাক্ত হয়েছিলেন এক কবি। তার নিদ্রাহীন পদচারণার প্রতিটি মুহূর্ত মুর্ত হয়েছিল দুর্বলের, শোষিতের মর্ম বেদনা। তিনি গর্জে উঠেছিলেন... তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। এর অব্যবহিত পরে তিনি ব্রিটিশ রাজ কে চিঠি লিখে জানান:
"The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and l for my part wish to stand,shorn of all special distinctions, by the side of those of my countrymen; who, for their so called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings."
   
    এই ব্যক্তি আর কেউ নন... স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
তিনি ব্রিটিশ রাজ শক্তির কাছে পাওয়া  "নাইটহুড" উপাধি বর্জন করেন। তিনি যুগান্তরের কবি ও সত্যদ্রষ্টাদের  প্রতিনিধি। যুগে যুগে মানবতা ও সভ্যতার সংকট যখন দেখা দেয় কবি, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীরাই তখন পথ দেখান...পথ দেখিয়েছেন।

    তবু আজও রাষ্ট্র ও তার যন্ত্র ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ পেরিয়ে ও আজকের দিনে ও শুনতে পাচ্ছি  NRC ক্যাম্পে রাষ্ট্রহীন, সর্বহারা দুর্বল মানুষের আর্ত হাহাকার, কাশ্মীরের রাষ্ট্র ক্ষমতার আস্ফালন। এবার কে পথ দেখাবে নিষ্পেষিত গণমানুষেরে?... এখন রাষ্ট্র ও তার যন্ত্র কবি,চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী দের সামনে ছড়িয়ে দিয়েছে মিথ্যা সম্মান ও পুরস্কারের রুটির টুকরো। ওরা তাই নিয়েই ব্যস্ত। ওরা পথনির্দেশক ও সত্যদ্রষ্টার ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

         এসো তবে সর্বহারা, এসো নিপিড়িত, শোষিত গনমানব। রাষ্ট্রের ঐ অচলায়তনে আঘাত করো... ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও রাষ্ট্র যন্ত্র.... নতুন আলো আসুক...

* ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত

No comments:

Post a Comment

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com