একটি নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস
১৩ এপ্রিল, ১৯১৯। পাঞ্জাবীদের নতুন বছরের প্রথম
দিন। চলছে বৈশাখী উৎসবের আনন্দ আয়োজন। এই আয়োজনেরই অংশ হিসেবে,জালিয়ানওয়ালাবাগের
ময়দানে সমবেত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল
ততদিনে বেরিয়ে গেছে।ইংরেজের হাতে পরাস্ত জার্মানি। গান্ধী তথা জাতীয় কংগ্রেস তো এই
যুদ্ধে ইংরেজদেরই জয় চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ প্রভু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,এই যুদ্ধে
ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করলে,ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। কিন্তু
যুদ্ধ শেষ হতেই চতুর বানিয়া শাসক সুর বদলাল। বিশ্বাস করে বঞ্চিত হল জাতীয় কংগ্রেস ও
ভারতীয় সৈন্যরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, ব্রিটিশ সরকার মন্টেগু-চেমসফোর্ড
আইন
সংস্কারের দ্বারা বুঝিয়ে দিলেন,ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কোন ইচ্ছেই তাদের নেই। এতে জাতীয় কংগ্রেস ও জনগণের মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধে।এ তো জানা কথা।ব্রিটিশ সরকার আগে থেকেই তা আঁচ করেছিল। তাই বিদ্রোহী ও বিক্ষুব্ধদের দমন করতেই ১৮ মার্চ, ১৯১৯ পাশ করা হয় রাওলাট আইন। এই আইন আসলে সম্পূর্ণরূপে মানুষের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারী একটি কলঙ্কিত আইন। এই আইনের দ্বারা শুধুমাত্র সন্দেহের বশে যে কোনো ভারতীয়কে গ্রেপ্তার, বিচার করা যাবে; এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল। গান্ধীজি এই আইনের বিরোধিতা করে অহিংস রাওলাট সত্যাগ্রহের ডাক দিলেন।
সংস্কারের দ্বারা বুঝিয়ে দিলেন,ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কোন ইচ্ছেই তাদের নেই। এতে জাতীয় কংগ্রেস ও জনগণের মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধে।এ তো জানা কথা।ব্রিটিশ সরকার আগে থেকেই তা আঁচ করেছিল। তাই বিদ্রোহী ও বিক্ষুব্ধদের দমন করতেই ১৮ মার্চ, ১৯১৯ পাশ করা হয় রাওলাট আইন। এই আইন আসলে সম্পূর্ণরূপে মানুষের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারী একটি কলঙ্কিত আইন। এই আইনের দ্বারা শুধুমাত্র সন্দেহের বশে যে কোনো ভারতীয়কে গ্রেপ্তার, বিচার করা যাবে; এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল। গান্ধীজি এই আইনের বিরোধিতা করে অহিংস রাওলাট সত্যাগ্রহের ডাক দিলেন।
পরের মাসের ৯ তারিখ দিল্লিতে রামনবমীর
অনুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করেই হয়। হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক আনন্দউদযাপনে মিলিত হয়। এই
উপলক্ষে গান্ধী দিল্লি রওনা দিতে চাইলে,তাঁকে বাধা দেওয়া হয়।দিল্লি ও পাঞ্জাবে
তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং পথেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।শীঘ্রই তাঁর
গ্রেফতারের খবর দেশে ছড়িয়ে পড়ে।এই আবহেই পরের দিন কংগ্রেসের দুই জনপ্রিয় নেতা ডাঃ
সত্যপাল ও ডাঃ সৈফুদ্দিন কিচলুরকে পাঞ্জাবে গ্রেফতার করা হয়।খবর ছড়িয়ে পড়তেই
উত্তেজিত হয়ে ওঠে জনতা। ঘেরাও করা হয়,রেলস্টেশন,পোস্ট অফিস,অফিস। পাঁচজন ইংরেজ এই
বিক্ষোভে মারা যান। একজন নার্সের উপরও চড়া হয় বিক্ষোভকারীরা।এই অগ্নিগর্ভ
পরিস্থিতিকে শান্ত করতেই পাঞ্জাবে নিয়োগ করা হয় জেনারেল ডায়ারকে।
পাঞ্জাবে জারি হল ১৪৪
ধারা। কিন্তু বৈশাখী উৎসবের আবহে সেই ধারাকে অগ্রাহ্য করে,জালিয়ানওয়ালাবাগের ময়দানে
সমবেত হাজার হাজার নিরস্ত্র জনতা। খবর গেল ডায়ারের কাছে। হাজার খানেক সৈন্য ও দুটি
সাজোয়া নিয়ে ডায়ার পৌঁছালেন,ময়দানে।চারদিকে উঁচু পরিখা। কয়েকটি
প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার আটক করে,সেই সাজোয়া গাড়ি ও সৈন্যদের হুকুম
দিলেন,নির্বিচারে সমবেত মানুষের উপর গুলি চালাতে। গুলি খেয়ে একের পর এক অসহায় মানুষ
লুটিয়ে পড়তে লাগল।কেউ কেউ পাশের কুয়োয় লাফ দিয়ে আত্মরক্ষা করার মরিয়া চেষ্টা
করল, কিন্তু নৃশংস ডায়ারের নির্দেশে তাঁদের পাথর চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হল।দীর্ঘ
একতরফা হত্যালীলা চালিয়ে যখন ডায়ার ও তাঁর সৈন্যদের রক্তপিপাসা শান্ত হল,তখন
তাঁদের বন্দুক থেকে খরচ হয়েছে ১৬০০ টির অধিক গুলি। সরকারি মতে মৃত্যু হয়েছে,৩৬৯ জনের,আহত
হয়েছেন ১২০০ এর মতো নিরপরাধ মানুষের। বেসরকারি মতে হতাহতের সংখ্যা এর চেয়ে
বহুগুণ। অবশ্য,এতদসত্ত্বেও অত্যাচারী ডায়ার নিজের পারফরমেন্সে খুশি হতে পারেন
নি, তিনি পরে আফশোস করে বলেছিলেন,রাস্তা ভালো হলে,আরও অনেক গোলাগুলি নিয়ে গিয়ে আরও
অনেক লোককেই মারা যেত।
এই নৃশংস ঘটনার পরে,সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে প্রবল
আলোড়ন উঠলেও, গান্ধীজি ও জাতীয় কংগ্রেস ঘটনার প্রেক্ষিতে তীব্র কোন প্রতিবাদ ব্যক্ত
করে নি।বরঞ্চ,রাওলাট সত্যাগ্রহ জনগণের দ্বারা গান্ধীর অহিংস মতাদর্শে চালিত হয় নি
বলে, তিনি খুব অখুশি ছিলেন এবং আন্দোলন তুলে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই প্রেক্ষাপটে
গান্ধীজিকে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবে প্রবেশ করে গ্রেফতার হতে চেয়িছিলেন, যাতে জনমানসে
ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়, কিন্তু গান্ধীজি তাঁর আবেদন রক্ষা করেন নি। পরে
চিত্তরঞ্জন দাসকেও এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে একটি সভা করতে অনুরোধ করেন
রবীন্দ্রনাথ,কিন্তু তাও ফলপ্রসূ হয় নি। অবশেষে কবি নিজে একাই এর প্রতিবাদ নিজের মতো
করতে চাইলেন।ব্রিটিশ সরকারের এই অত্যাচারী মানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লিখলেন
কড়া চিঠি এবং জানালেন ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইটহুড ত্যাগের ইচ্ছের
কথাও। জালিয়ানওয়ালাবাগের শহীদদের উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের এই শ্রদ্ধা আজও কবির প্রতি
আমাদের মাথা নত করে তাঁর চরণধূলার' পরে।
* ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত
* ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত