শতবর্ষে জালিয়ানওয়ালবাগ
১৯১৪ সালের
আগস্ট মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। এই যুদ্ধে ব্রিটেন পরাধীন ভারত থেকে ৮ লক্ষ
সৈন্য ও ৪ লক্ষ যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কর্মচারী (Non-combatants) সংগ্রহ করেছিল। যুদ্ধের সময় ভারতীয়দের ব্রিটেনকে
সাহায্য প্রদানের উৎসাহ এত ব্যাপক দেখা দিয়েছিল যে, মহাত্মা গান্ধীও তখন
ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য সংগ্রহের কাজে সহায়তা প্রদান করেন।
কিন্তু ভারতবাসীর এই উৎসাহ স্তিমিত হতে বেশী দেরী হল না। ১৯১৬ সালের প্রথমদিকে
দেশে হতাশা গ্রাস করতে শুরু করল; সরকার ক্রমশ সৈন্য সংগ্রহ ও যুদ্ধের খরচ সংগ্রহের
যে পদ্ধতি অবলম্বন করল, তাতে ব্রিটিশ সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে সংশয় উপস্থিত হল।
মূল্যস্তরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি করলো। বাংলায় বৈপ্লবিক সশস্ত্র আন্দোলন
পুনরায় শুরু হল। মুসলমান জনগনের মধ্যেও ব্রিটিশের যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিশেষ
অসুন্তুষ্টি দেখা দিল। তুরস্কের সুলতানকে মুসলমান সম্প্রদায় ‘খলিফা রূপে গন্য করত
অথচ বিট্রিশ সরকার তুরস্কের
বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়েছিল। ১৯১৫ সালে গোখলে এবং ফিরোজ শা মেহেতার মৃত্যুতে নরমপন্থীগণ দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে তিলক বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে শীঘ্রই জাতীয়তাবাদীদের উপর নেতৃত্ব পুন:প্রতিষ্ঠা করল। ভারত দরদী ইংরেজ মহিলা শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত হোমরুল লীগ স্থাপন বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯১৬ সালে লক্ষ্নৌতে কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের মধ্যে একটি চুক্তি হল; এই চুক্তির দ্বারা মুসলীম লীগের স্বায়ত্বশাসনের দাবির সমর্থনের বিনিময়ে আন্দোলনে যোগদান করতে সম্মত হল এবং কংগ্রেস মুসলীম লীগের পৃথক নির্বাচনের দাবি সমর্থন করল। এই লক্ষ্নৌ চুক্তির দ্বারা ভারতের জাতীয় আন্দোলনে অভূতপূর্ব ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল।
বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়েছিল। ১৯১৫ সালে গোখলে এবং ফিরোজ শা মেহেতার মৃত্যুতে নরমপন্থীগণ দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে তিলক বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে শীঘ্রই জাতীয়তাবাদীদের উপর নেতৃত্ব পুন:প্রতিষ্ঠা করল। ভারত দরদী ইংরেজ মহিলা শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত হোমরুল লীগ স্থাপন বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯১৬ সালে লক্ষ্নৌতে কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের মধ্যে একটি চুক্তি হল; এই চুক্তির দ্বারা মুসলীম লীগের স্বায়ত্বশাসনের দাবির সমর্থনের বিনিময়ে আন্দোলনে যোগদান করতে সম্মত হল এবং কংগ্রেস মুসলীম লীগের পৃথক নির্বাচনের দাবি সমর্থন করল। এই লক্ষ্নৌ চুক্তির দ্বারা ভারতের জাতীয় আন্দোলনে অভূতপূর্ব ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল।
১৯১৬ সালের মার্চ
মাসে লর্ড ও চেমসফোর্ড, হার্ডিঞ্জের স্থলে ভারতের বড়লাটের কার্যভার গ্রহণ করলেন। এই
সময় হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দ্বারা ভারতের জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং নরমপন্থীগন
ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায় চরমপন্থীগনের জাতীয় কংগ্রেসের আভ্যন্তরে আধিপত্য স্থাপিত
হলো। অন্যদিকে ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউ ভারতে এসে পড়ে। ভারতের
বিপ্লবীদের একাংশ রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, মার্কস ও এঙ্গেলস-লেনিন সম্পর্কে আগ্ৰহী
হয়ে ওঠে।
ফলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে
প্রত্যক্ষ কোন গন আন্দোলনের আয়োজন না থাকার সত্বেও, ব্রিটিশ সরকার ভারতের সমস্যা
গুলিকে নতূন দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা বিচার করতে প্রনোদিত হল। চেমস্ ফোর্ড শাসনতান্ত্রিক
সংস্কার কি ভাবে সাধিত হয় সে সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে লাগলেন এবং এ সম্পর্কে কতিপয়
নিজস্ব প্রস্তাবও উত্থাপন করলেন। তাঁর এই প্রস্তাব গুলি যথেষ্ট সন্তোষজনক জনক বলে মনে
হয়নি --- এমনকি তার শাসন পরিষদের ভারতীয় সদস্য শঙ্করন নায়ার বড়লাটের প্রস্তাবগুলি
যথেষ্ট নয় বলে নয় বলে অভিমত দেন। ভারতসচিব চেম্বরলেন ও এই প্রস্তাব গুলি যথেষ্ট নয়
বলে মনে করলেন। চেমস্ ফোর্ড তখন ভারতসচিবকে উপস্থিত হয়ে স্বয়ং অবস্থা পর্যবেক্ষণের
জন্য অনুরোধ করলেন। ভারতে আসার পূর্বে মন্টেগু ১৯১৭ সালের ২০শে আগষ্ট কমন্স সভায় ভারতের
শাসনতান্ত্রিক অগ্ৰগতি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নীতি ঘোষনা করলেন। এই ঘোষণায় বলা
হল ---"The policy of his majesty's government with which the government of
India are in complete accord in that of increasing association Indians in every
branch of administration and gradual development of self-governing institution
with a view to progressive realisation of responsible government in India as an
integral part of the British Empire".
এই ঘোষণার কয়েক
মাস পরেই, ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে ভারতসচিব মন্টেগু ভারতে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি
ভারতে অবস্থান করে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ আলোচনা করেl এবং বড়লাট
চেমস-ফোর্ডের সঙ্গে সংযুক্তভাবে ভারতের শাসননতান্ত্রিক অগ্রগতির প্রস্তাব গ্রথিত
করে একটি বিবরণী রচনা করলেন।
মন্টেগু-চেমস ফোর্ড শাসনতান্ত্রিক
সংসস্কার সম্বন্ধে আলোচনা চালাবার পাশাপাশি শাসনকর্তারা নিজেদের মত একটি চরমনীতির
অস্ত্রেও শান দিচ্ছিল। ব্রিট্রিশ পার্লামেন্টে ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার
ঘোষনার পর কয়েকমাস কাটতে না কাটতেই বড়লাট চেমস ফোর্ড ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি
কমিটি তৈরি করলেন, বিচারপতি রাওলাটকে চেয়ারম্যান করে। এই কমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল-
ভারতবর্ষে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলির বৈশিষ্ট্য, বিস্তৃতি বা
গভীরতা এসব তদন্ত করে তাদের জব্দ করতে কি চরম আইন তৈরি করা যেতে পারে তা বাতলে দেওয়া।
রাওলাট কমিটি নামে কুখ্যাত এই যড়যন্ত্র
তদন্ত কমিটতে চেয়ারম্যান ছাড়া ছিলেন দুই ইংরেজ ও দুই ভারতীয়। নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তার
মধ্যে এদের কাজকর্ম চলছিল। কোন সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া সরকারের যোগানো তথ্যের
ভিত্তিতে আইন তৈরির প্রস্তাব এল কমিটির তরফ থেকে। কমিটির এই রিপোর্টের ভিত্তিতে
ভারত সরকার দুটি বিলের খসড়া তৈরি করল- অপরাধ আর রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত
ব্যক্তিদের বিচারের কাজটা সহজ সরল করে তোলা আর অভিযুক্ত ব্যক্তির সব অধিকারকে একদম
ছেঁটে মুড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাস্তানাবুদ করারও নামান
ব্যবস্থা রাখা হল বিল দুটিতে। রাওলাট কমিশন বা সিডনী কমিশনের সুপরিশের ভিত্তিতে
১৯১৯ সালের ১৮ মার্চ ভারত সরকার দমন মূলক এই আইন পাশ করে যা ‘রাওলাট আইন’ নামে পরিচিত।
এই আইনের প্রধান প্রধান শর্তাবলীঃ
১. প্রচারে
বাধাঃ এই আইনে সরকার বিরোধী সবরকম প্রচার দন্ডনীয়
অপরাধ বলে গণ্য হয়।
২.
প্রেপ্তার ও আটকঃ সন্দেহভাজন যে কোন ব্যক্তিকে বিনা প্ররোচনায় প্রেপ্তার করা ও বিনা
বিচারে অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটক বা নির্বাসন দেওয়া যাবে।
৩. জুরি ও
সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া বিচারঃ এই আইনে বিচারকরা জুরি ও সাক্ষ্য প্রমান ছাড়া বিচার
করতে পারবেন।
৪. বাড়ি
তল্লাশি : এই আইনে সরকার বিনা পরোয়ানায় বাড়ি তল্লাশি করতে পারবে।
৫. আপিলে
নিষেধাজ্ঞা : এই আইনে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে কোন আপিল করা যাবে না।
৬. সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ : এই আইন বলবৎ
থাকার সময় কোন সংবাদ মাধ্যম স্বাধীন ভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না।
কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে এই
আইন সংখ্যাধিক্যে গৃহীত হলেও মহম্মদ আলি জিন্নাহ,
মদন মোহন মালব্য, মজাহার উল হক প্রমুখ আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। এই প্রসঙ্গে
জিন্নাহ বলেছন- The fundamental principal of justice have been imported and
constituional right of the feople have been unrooted at a time when there is no
real danger to the state. অমৃত বাজার পত্রিকা এই আইনকে ‘A Gigantic blunder’ বলে অভিহিত করে।
গান্ধীজী ব্যাঙ্গ করে বললেন ‘উকিল নেহি, দলিল নেহি, আসিল নেহি।
এই আইন জারি হবার পর মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লো।
বঙ্গভঙ্গের পর এত ব্যপক এত বিস্তৃত রাজনৈতিক ক্ষোভের বহি:প্রকাশ লক্ষ্য করা গেল।
সরকার বাহাদুর থোড়াই কেয়ার করলেন এই ক্ষোভগুলিকে। এর বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন
শুরু করার উদ্যোগ নিয়ে গান্ধীজী সর্বভারতীয় স্তরে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে হাজির হলেন।
শুরু হলো ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন’। সংগ্রামের সূচনা স্বরূপ গান্ধীজী দেশব্যাপী একদিনের হরতালের ডাক দিলেন। ৬ই এপ্রিল এক
ঐতিহাসিক হরতাল পালিত হলো। সমগ্র দেশ উত্তাল হলো গণবিক্ষোভে আর সরকারও হয়ে উঠলো নির্মম।
ইতিহাসবিদ বিপান চন্দ্রের মতে ‘The entire
country was electrified’. লাহোর, গুজারানওয়ালে,
কাসুর ও পাঞ্জাবের আরো অন্য সব জায়গায় মুখোমুখি সংঘর্ষ বেধে গেল সাধারণ মানুষ আর
ক্ষিপ্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে। বিক্ষুদ্ধ গণচিত্তের এক অভূতপূর্ব ক্ষোভের অভিব্যক্তি
লক্ষ্য করা গেল। এই গণ অভ্যুত্থানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাঞ্জাব। পাঞ্জাবের গর্ভনর
মাইকেল ও’ডয়ার এই আন্দোলনকে পিষে মারার জন্য কায়েম করলেন বীভৎস অত্যাচারের শাসন।
দুই বিশিষ্ট নেতা ডাঃ সত্য লাল ও ড. সৈফুদ্দিন কিচলুকে অন্তর্ধানে পাঠানো হলো। এর
প্রতিবাদে হরতাল, বিশাল বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ চললো। এসব ঘটনা, যখন চলছে, তারই
মধ্যে গান্ধীজীর গ্রেপ্তারের খবর পৌঁছাল পাঞ্জাবে। পাঞ্জাবের মানুষ প্রতিবাদ সামিল
হলো। সমবেত জনতার উপর পুলিশ নির্মম গুলি নিক্ষেপ করলে মানুষ ক্ষেপে গিয়ে
হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। হিংসার অভিযোগে সরকার অমৃতসর শহর তুলে দিলো মিলিটারির হাতে।
জেনারেল ডায়ার হয়ে উঠল সর্বেরসর্বা। ডায়ারের হাতে ক্ষমতা আসার সঙ্গে সঙ্গেই
দমনপীড়নের তাণ্ডব আরো প্রবল হয়ে উঠল। নির্বিচারে চলল ধর পাকড়। সভাসমিতি, অনুষ্ঠান
সব নিষিদ্ধ। ১৩ই এপ্রিল বিকাল সাড়ে চারটায়
জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি জনসভা হবার কথা ছিল। ডায়ারের মতে ছ’হাজার, অন্যদের মতে দশ হাজার মানুষ এই সভায় এসেছিল। এই
জনসভা বে-আইনি, সমবেত জনতাকে অবিলম্বে সভা ছেড়ে চলে যেতে হবে- ওসব আগে থেকে
জানানোর কোন মাথাব্যাথা ছিল না ডায়ারের। উল্টে লোকজনকে সভার মাঠে আসার সময় একটুও
বাধা দিলেন না তিনি। মাঠটা যখন কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেল, তখন তিনি গুলি চালানোর আদেশ
দিলেন। তাতে এত মানুষের প্রাণ গেল, এত মানুষ ঘায়েল হলো যে, তা ‘বড্ডো বাড়াবাড়ি’
হয়ে গিয়েছিল বলে সরকারই স্বীকার করেছিল। নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাব মতো প্রথমে
ছিল দুশো আশি, পড়ে সরকারি হিসাবেই দাঁড়ালো তা পাঁচশোতে, বেসরকারী হিসাব তো
একহাজারের ও বেশী।
জালিয়ানওয়ালাবাগটা
খুবই ছোট্ট। ঢোকার আর বেরনোর একটাই মাত্র সরু পথ সেখানে লাঠি চার্জ হলে বা গুলি
চললে, সেখনে থেকে পালিয়ে যাবার কোন উপায়
ছিল না, লাঠি গুলি খেতেই হবে। এব্যাপারে তদন্তের সময় পরে ডায়ারকে জিজ্ঞাসা করা
হয়েছিল, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ‘নিজের মান সম্মান’ গুলি চালিয়ে রক্ষা করেছেন। শুধু অমৃতসর শহর নয়, সারা
পাঞ্জাবকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলাই ছিল তার উদ্দেশ্যে। এটা শুধু ডায়ারের নীতি ছিল
না, এই নীতিতে ছিল ব্রিটিশ সরকারের পূর্ণ মদত। কিন্তু এই নৃশংস হত্যালীলার নিন্দা
করেছিলেন ইংল্যান্ডের গনতান্ত্রিক মনোভাবপন্ন মানুষের একাংশ। আর তাদের চাপে
সরকারের এই ঘটনার তদন্তের জন্য একটি কমিশন তৈরি করে। যদিও কমিশনের রিপোর্টে যাতে
ডায়ারের অনুকুলে যায় সে ব্যাপারে তারা
যথেষ্ট সচেতন ছিল।
তবুও কমিটির ইউরোপীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও
জেনারেল ডায়ারের কুকার্যকে সম্পূর্ণ সমর্থন করতে পারেনি। তাদের মতে ডায়ারের
কুকার্যটা ঘোরতর অমানবিক। তারা রির্পোটে এ প্রশ্ন তোলেন জনতাকে সর্তক না করে গুলি
চালানো হল কেন? গুলি বর্ষনের কাজটা এত দীর্ঘক্ষন চালানো হল কেন? এই সরকারী তদন্তের
সমান্তরাল এই সময়ই সরকারীভাবে তদন্ত চালাচ্ছিলেন কংগ্রেস নিযুক্ত একটি কমিটি- মতিলাল
নেহেরু, সি আর দাশ, ফজলুল হক এবং আব্বাস তায়েবজি ছিলেন এই কমিটির সদস্য। হাজার
খানেক লোকের সাক্ষ্য নিয়ে তারা যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন তাতে বলা হয় নরহত্যার যে
তান্ডব চালানো হয়েছিল তা হিংস্রতায় আধুনিক ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসের পাতায়
নজিরবিহীন কলঙ্কিত ঘটনা।
জালিয়ানওয়ালাবাগে শুধু গুলি বর্ষণ নয়,
তার আগে সামরিক আইন অনুযায়ী বিশেষ কোন কোন রাস্তা দিয়ে জনগনকে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হত। কর্তাদের চোখে যারাই
অপরাধী বলে চিহ্নিত হত তাদের প্রকাশ্যে বেত মারা হত। গণ অভ্যুত্থানকে সমূলে উৎপাটিত
করার নানান ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে একথা বলা যায় জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার আগে আর
পরে দমনপীড়নের যে তান্ডব ব্রিটিশরা করেছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের ভুমি
থেকেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল খিলাফত আন্দোলন।
জালিয়ানোওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পিছনে
মুখ্য ভূমিকা ছিল রাওলাট আইনের। বর্তমানে দেশে Unlawful Activities (Prevention) Act, এর সংশোধন (Amendment) হয়েছে। বিলটি লোকসভায় বিতর্ক চলাকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, দেশে থেকে সন্ত্রাস নির্মূল
করতে ব্যক্তিকেও এই আইনের আওতায় আনা জরুরি। গত ২৪ জুলাই লোক সভায় এই সংশোধনী
প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এই আইনে সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসবাদীর কোন সংজ্ঞা দেওয়া হয় নি।
তবে এখানে বলা হয়েছে, ভারতের একতা, অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব, সাধারণ নিরাপত্তা নিয়ে কোন কাজ বা ভারতের বা
বিদেশের যে কোন অংশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বা সন্ত্রাস ছড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে করা
কোন কাজ ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’ হিসাবে গণ্য হবে। পূর্বের আইনের ৪ এবং ৬ নম্বর
ধারায় কোন সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ ঘোষনা করার প্রক্রিয়া নথিবদ্ধ রয়েছে। বর্তমান
আইনে এর পরিসর বাড়িয়ে ব্যাক্তি বিশেষকে এই ঘোষনার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সু্যোগ দিতে বাধ্য থাকবে না সরকার। পূর্বের আইন
অনুযায়ী তদন্তকারি অফিসারকে এই মামলায় কোথাও তল্লাশি চালানো বা কিছু বাজেয়াপ্ত
করার আগে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলের অনুমতি নিতে হতো।
প্রস্তাবিত সংশোধনী বিল অনুযায়ী তদন্তকারি যদি এম.আই.এর অফিসার হল, তাহলে এই
অনুমতি এন.আই.এ’র ডিরেক্টর জেনারেল থেকে নিলেই হবে। পূর্বের আইনে শুধুমাত্র এন.আই.এ’র
ডেপুটি সুপারিন্টেড বা অ্যাসিস্ট্যন্ট কমিশনার পদমর্যদার অফিসারই এই আইনে রজু হওয়া
মামলার তদন্ত করতে পারতেন। বর্তমানে এন.আই.এ’র ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অফিসারদের
তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আসলে ব্যক্তিকে জঙ্গি সন্দেহে প্রেপ্তার
করার এ-হেন ক্ষমতা দেওয়ার গূঢ় কারণ হলো- সরকারের নানা কাজকর্মের সমালোচক, মানবাধিকার
কর্মীদের গ্রেপ্তার করে ভয়ের বাতাবরণ তৈরী করা যাতে কেউ প্রতিবাদ না করতে পারে।
কারণ আইনের মূল কাঠামোটাই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এর অপব্যবহার হতে বাধ্য।
দায়বদ্ধহীনতা, অবাধ ক্ষমতা কতখানি আইনরক্ষকদের দানবে পরিনত করে তার অভিজ্ঞতা
রাওলাট আইনে আমরা লক্ষ্য করেছি। এন. আই.এ. যে পক্ষপাত দুষ্ট এতে পারে তা আমরা লক্ষ্য
করেছি। অকাট্য প্রমান থাকা সত্বেও সাধ্বী প্রজ্ঞাকে নির্দোষ বলা, সোহরাবুদ্দিন
মামলায় অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস করা, মুজাফরনগর দাঙ্গায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে
মামলা তুলে নেওয়া, আখলাক জুনাইদ, পেহলু খানদের মামলায় নানা আইনী সমঝোতার অভিযোগ
উঠেছে। তদন্তকারী সংস্থা যদি শাসকের আঙ্গুলিহেলনে চলে তবে সংখ্যালঘু ও প্রতিবাদীদের
বিপন্নতা বাড়বে।
সমাজতত্বের প্রাথমিক জ্ঞান দিয়ে বলা যায়
যে, যারা নিজেদের শরীরকে মানববোমার
মাধ্যমে উৎসর্গ করে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের কারনে, তাদের কাজে কোনও কঠোর আইনই
যথেষ্ট নয়। বিষয় বা সমস্যাটি এখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। সুতরাং সামরিক
শক্তি ও কঠোর আইন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যায় না।
* ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত
লেখকের লেখার হাতটি চমৎকার। আগে কোনদিন লেখকের লেখা পড়িনি, হয়তো উনি প্রতিষ্ঠিত লেখক। ইতিহাসকে তিনি দারুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। ভবিষ্যতে লেখকের আরো লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteএকটা তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। লেখক মুন্সিয়ানার সঙ্গে জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রেক্ষাপট এবং আজকের দিনে ভারতবর্ষে এই ঘটনার গুরুত্ব সুন্দরভাবে উদাহরণ সহযোগে ব্যাখ্যা করেছেন। চমৎকার লেখা।
ReplyDelete