গদ্যঃ বিকাশ চন্দ্র বাগদি





বাংলা ছড়া ও বাগদি ইতিকথা


 'ছড়া' লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সাহিত্যসম্পদ। মানবসমাজ যখন থেকে মনের ভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে, তখন থেকে মানুষ তার ব্যবহারের তাগিদে ছড়া সৃষ্টি করেছে। মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই ছড়া আপনাআপনি সৃষ্টি হয়েছে। আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে, একদেশ থেকে অন্য দেশে বিভিন্ন রুপে-রসে সিক্ত হয়ে ছড়া চলে আসছে। ছড়ার রচয়িতারা আজ বিস্মৃতির অন্তরালে কিন্তু তাঁদের সৃষ্ট ছড়াগুলি লোকমানসের স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে ব্যাপ্তি ও চিরন্তন হয়ে উঠেছে।

স্বল্পশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত কিম্বা অশিক্ষিত লোকজীবন তাদের অজান্তেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োগে ছড়া সৃষ্টি করেছে।আর সেই ছড়াগুলিই সাহিত্যশাখাকে পরিপুষ্ট করেছে। ছড়া শুধু যে কালে কালে সমাজ-মানসিকতার পরিচয় বহন করছে তা নয় ; ছড়া ঐতিহাসিক কালজয়ী দলিলরুপেও পরিচিত যে দলিলে ধরা পড়ে বিভিন্ন জাতি, বর্ন, সমাজ কাঠামো, রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার-আচরন, সংস্কার-কুসংস্কার প্রভৃতি

     বাগদি জাতি নিয়ে যেসব ছড়াগুলি প্রচলিত আছে তা হল-
()              "আয় ঘুম আয় ঘুম বাগদিপাড়া দিয়ে
                 বাগদিদের ছেলে ঘুমায় জাল মুড়ি দিয়ে।।" ()
()              "বগা রে বগিরে এবার বড়ো বান
                 ডাঙা দেখে ঘর বাঁধব খুঁটে খাব ধান
                 বগার মাথায় লালপাগড়ি, বগির মাথায় চুল
                 সত্যি করে বল রে বগা যাবি কত দূর
                 আমি যাব বিলে বিলে
                 দুইটি কাতলের মাছ ভেসে উঠেছে
                 দাদার হাতে লকড়িখান ফেলে মেরেছে।।"()

()              "হ্যাদে রে কল্মিলতা
                 এতকাল ছিলে কোথা
                 এতকাল ছিলাম বনে
                 বনেতে বাগদি ম ' ,
                 আমারে যেতে হল
                 তুমি নেও কলসী কাঁকে
                 আমি নিই বন্দু হাতে
                 চলো যাই রাজপথে
                 ছেলের মা গয়না গাঁথে,
                 ছেলেটি তুড়ুক নাচে।।"()

()              "হ্যা দেখ্ লো কল্মিলতা
                 জল শুকুলে থাকব কোথা?
                 জল শুকুলে থাকব বনে?
                 বনে যে বাগদি ম'
                 চিঁড়ে দই খেতে হল
                 দেয় না রাজা পথ -খরচা
                 বাঁধব তোর ঘর দরজা
                 আসবে বাবু ভেয়ে
                 দেখব চেয়ে চেয়ে
                 আর পড়বে আছাড় খেয়ে।।"()

()              "এক খোলা জল হিঁচে
                 তু মাজায় দিলি হাত
                 তু কি করে খাবিরে
                 বাগদিনীর ভাত?"()

  পুরুষশাসিত সমাজে অন্দরমহলের মেয়েদের দ্বারা নানা কাজ সাধিত হত মনের স্বাভাবিক স্ফূর্তিতে কখনো শিশুর কান্না থামাতে, ঘুমপাড়াতে বা সোহাগ আদর জানাতে, শিশুদের অনেক আবদারে, স্নেহের স্পর্শে আদরনীয় করে তুলতে ছড়া বলত সেই ছড়া কখনো দেবদেবীকে নিয়ে কখনো বা নানা পশুপাখীকে নিয়ে, কখনো বা নানা পাড়াকে নিয়ে, কখনো বা কোনো বিশেষ মানুষকে কেন্দ্র করে কখনো বা অন্য পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুলনা করে আবার কখনো কোনো জাতিকে নিয়ে ঘুমপাড়ানো এমন একটি বাগদি জাতি-বিষয়ক ছড়া হল আমাদের পূর্বে উল্লেখিত প্রথম ছড়া-
                    ' আয় ঘুম আয় ঘুম বাগদিপাড়া দিয়ে
                    বাগদিদের ছেলে ঘুমায় জাল মুড়ি দিয়ে।।'

  এই ছড়াটির মধ্য দিয়ে সুরেলা কন্ঠে শিশুকে ঘুমপাড়ানো যেমন হয়,তেমনি এটির মধ্য দিয়ে বাগদি জাতি সম্প্রদায়ভুক্ত ছেলেমেয়েদের ঘুমাবার সামান্য উপকরনটির কথাও উল্লেখ হয় বস্তুত এটির মধ্য দিয়ে বাগদি জাতির পেশার সঙ্গে তাদের সমাজ অর্থনীতির দিকটি ফুটে উঠে ফুটে ওঠে সামান্য উপকরনে বাগদি বাড়ির ছেলেদের কত শান্তি ও স্নিগ্ধতা ছড়াটির মাধ্যমে বাগদি জাতি সম্পর্কে একটা সম্যক পরিচয় দান করলেও কিছুটা যেন হীনতার দৃষ্টিরুপে ফুটে ওঠে কারন বাগদি জাতির অন্যতম একটা পেশা হল মাছ ধরা মাছ ধরতে জাল ব্যবহার করতে হয় তা বলে বাগদি ছেলেদের অন্য কোনো পরিধেয় বা গায়ে দেওয়ার মতো বস্ত্র থাকবে না? যদি ও কবিগুরু "রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় ' ওই শেষ ছত্রে জাল মুড়ি দিয়া বাগদিদের ছেলেটা যেখানে সেখানে পড়িয়া কিরুপ অকাতরে ঘুমাইতেছে সে ছবি পাঠকমাত্রেই উপলব্ধি করিতে পারিবেন অধিক কিছু নহে, ওই জালমুড়ি দেওয়ার কথা বিশেষ করিয়া বলাতেই বাগদি সন্তানের বিশেষরূপে প্রত্যক্ষ হইয়াছে
    অনেক সময় মা ছেলেকে সোহাগ করে নানাভাবে মা নিজে অনেক কথা উল্লেখ করে খোকার উদ্দেশ্যে বা কখনো অনেক প্রশ্ন করে থাকে খোকাকে মা-ই আবার সেই প্রশ্নের উত্তর দান করে উত্তরদান করতে আদরের শিশুকে কখনো কেলো নিয়ে নাচায় বা তার সম্পর্কে অনেক ভাবনা ভাবতে থাকে আমাদের পূর্বে উল্লেখিত ৩নং ছড়াটি হল এ ধারার ছড়া ছড়াটিতে প্রথমে সম্বোধন করে বলা হয়েছে-

                 "হ্যাদে রে কল্মিলতা
                 এতকাল ছিলে কোথা'

-অনেক দিন দেখা না হলে বা অনেক দিন যেন দেখেনি এমন বোঝাতে এটি ব্যবহার করা হয়েছে বা জিজ্ঞাসার সুরে বলেছে আবার উত্তর দানও করেছে-
                 'এতকাল ছিলাম বনে
                 বনেতে বাগদি ম',
                 আমারে যেতে হল'

-উত্তরদান এমন যে আমি অরন্যচারী হয়েছিলাম এখন যারা আমাদের দেখতো, বাগদিরা তারা নেই তাই আমাকে যেতে হয়েছিলো
                 'তুমি নেও কলসী কাঁকে
                  আমি নিই বন্দু হাতে
                  চলো যাই রাজপথে'
-মা তুমি কলসী নাও আমি বন্দুক নিচ্ছি তারপর রাজপথের দিকে যাব অর্থাৎ মা নিজেই যেন ছেলের কাঁধে দায়িত্বভার দিচ্ছেন
     মা ছেলের কাঁধে দায়িত্বভার তুলে দিয়ে, আপনমনে মনের সুখে গহনা পরতে থাকেন
     ছেলেটি তখন যেন ব্যাঙের মতো নাচতে থাকে, ' ছেলেটি তুড়ুক নাচে '
     আলোচ্য এই ছড়াটির অন্য পাঠে ( আমাদের উল্লেখিত চতুর্থ ছড়া ) কল্মিলতা সম্বোধন করে জিজ্ঞাস করা হয়েছেসে এতদিন কোথায় থাকবে? কারণ  কল্মিলতা একটি শাক বিশেষযা সাধারনত পুকুরে হয়কিন্তু জল শুকিয়ে গেলে কোথায় থাকবেউত্তর আসে বনে থাকবেকারণ এখানেও বনেতে বাগদি মরেছে
      তাই ' চিড়ে দই খেয়ে ' থাকতে হবেকারণ রাজা তেমন কোনো খরচা দেয় নাতাই বাড়িঘর তেমন তৈরি করাও হয় না
                   'দেয় না রাজা পথ -খরচা
                     বাঁধব তোর ঘর দরজা'
    বাবু সম্পর্কে তাই অভিমান মিশ্রিত ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছেতাই বলেছে-
                   ' আসবে বাবু ভেয়ে
                    দেখব চেয়ে চেয়ে
                    আর পড়বে আছাড় খেয়ে'

- আলোচ্য ছড়াটিতে বাগদি জাতি যে যোদ্ধা জাতি সে কথা এখানে বলা হয়েছে কারণ আমরা তো জানি বাগদি জাতি একদা রাজা, জমিদারদের সৈনিকের বা লাঠিয়ালের কাজ করত কিন্তু বাগদিদের আর সৈন্যতে দেখা যায় না তাই রক্ষক হিসাবে বাবুকে মা-কামনা করছে কামনার সাথে সাথে বাগদি সৈনরা তাদের সঠিক পারিশ্রমিক পেত না তার কথাও কিন্তু ছড়াটিতে বলা হয়েছে শুধুমাত্র পেটে ভাতে খেয়ে লাঠিয়াল বা সৈনিকের কাজ করতে হতো তাই তাদের বাড়িঘরও তেমন ছিল না

 বাগদি জাতি বাঘের সঙ্গে তুলনীয় বাঘ থেকে বাগদিদের বলা হয় 'বাগা' বাগা থেকে  বোধহয় এসেছে 'বগা' আর এর স্ত্রীলিঙ্গে বগি আর বগা ও বগি নিয়ে রচিত ছড়াতে বাগদি জাতির পেশার পরিচয় ফুটে উঠেছে আমাদের পূর্বে উল্লেখিত ২ নং ছড়াটিতে

ছড়াটির সূচনায় বন্যাকূল বাংলার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এ হেন পরিবেশে মানুষের থাকা খুবই কষ্টকর সেই সঙ্গে সারা বছরভর খাওয়া-দাওয়ার একটা অভাব অনটনের রূপ ফুটে উঠেছে-
                 ' বগা রে বগিরে এবার বড়ো বান
                 ডাঙা দেখে ঘর বাঁধব খুঁটে খাব ধান'

   তাই বগা বগি খাদ্যের অন্বেষনে বের হয়েছেযদিও বগার মাথায় লাল পাগড়ির কথা বলা হয়েছেএই লাল পাগড়ি সাধারনত লাল গামছাকেও বোঝাতে পারেবগা মাছ ধরতে যাবেকারণ বর্ষাকালে যদি কিছু মাছ পায় তাহলে জীবন ধারণ করার কিছু পাওয়া যাবেতাই-
                 ' আমি যাব বিলে বিলে '

  এ হেন অবস্থায় দুটি কাতলা মাছ ভেসে থাকায় লকড়ি বা হাতের লাঠি দিয়ে সে মাছ মারতে চেয়েছে

                   ' দুইটি কাতলের মাছ ভেসে উঠেছে
                     দাদার হাতে লকড়িখান ফেলে মেরেছে'
  আলোচ্য ছড়াটির মধ্য দিয়ে বাগদি সম্প্রদায়ের একটি পেশার উল্লেখ করা হয়েছেবাগদিরা যে সমস্ত পেশাগুলির উপর নির্ভর করে জীবনধারণ করেতার মধ্যে মৎস্য শিকার অন্যতম ছাড়াও বাগদিদের বর্ষাকালে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাসস্থানের যে করুন দশা হয় তার প্রমান আমরা ছড়ার প্রথমেই দেখিতাই উঁচু স্থানে বাগদিরা ঘর বাঁধতে চায়কারণ বাগদিরা সাধারনত খালের বা বিলের ধারে, নদীর চরে বা কিনারে বসবাস করেতাই তাদের জীবনে এতো দুর্ভোগতাই তারা আর দুর্ভোগ যন্ত্রনাময় জীবন চায় না

 আমাদের পূর্বে উল্লেখিত পঞ্চম তথা শেষ ছড়াটিতে নারীমনের কথা বলা হয়েছেএখানে নারী হল প্রতিবাদী নারীতার প্রতিবাদ মুখরিত হয়েছে-
                 "এক খোলা জল হিঁচে
                 তু মাজায় দিলি হাত
                 তু কি করে খাবিরে
                 বাগদিনীর ভাত?”
 বাগদি সমাজে নারীপুরুষ উভয়েই হয় কর্মঠ এই জাতি শারীরিক পরিশ্রমে বেশি ক্লান্ত হয় না পুরুষটি যখন একটু মাত্র জল হেঁচে কোমরে হাত দিয়েছে তখনই বিদ্রুপ ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে, সেই সঙ্গে অনাদরও বাগদিনীর সঙ্গে সংসার করতে হলে পুরুষটিকে প্রচুর পরিশ্রমী হতে হয় খেটে খাওয়ার ও খাওয়ানোর মতো শরীর দরকার তবেই সংসার টিকে থাকবে অর্থাৎ স্থায়ী হবে

এ ভাবেই ছড়াগুলিতে বাগদিদের ইতিকথা তথা ইতিহাস রচিত হয়েছে

তথ্যসূত্র:-
. সুনীল জানা   সংকলন ও সম্পাদনা, 'চিরকালের ছড়া', দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ ২০০৫, পৃষ্ঠা-২৬
. সুনীল জানা   , পৃষ্ঠা- ১৬৬
. সুনীল জানা   , পৃষ্ঠা- ২০৮
. সুনীল জানা   , পৃষ্ঠা- ২০৯
. দেবব্রত কুনুই 'বীরভূম জেলার লোকসংস্কৃতি', উপজনভুই পাবলিশার্স, মাথাভাঙা, কুচবিহার, প্রথম প্রকাশ-১৪২১, পৃষ্ঠা-৬৯

No comments:

Post a Comment

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com