জালিয়ানওয়ালাবাগঃ অভিজিৎ দাশগুপ্ত




ইতিহাসের দেয়ালে লেগে থাকা রক্ত


রাষ্ট্রের চোখে চশমা। সে রঙিন হোক অথবা সাদা- তার পিছনে ঢাকা পড়ে যায় জরুরী কিছু বিষয়। একশো বছর আগে এমনই এক আইন তার কার্যকারণ হারিয়ে  ফেলেও শুধু টিকে ছিল রাষ্ট্রনায়কদের একগুঁয়েমির কারণে। যেমন রাওলাট আইন। রাজদ্রোহ দমনের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই আইনটি কমিশন প্রয়োগ করে। জরুরী ভিত্তিতে করা এই আইনটি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কেন্দ্রীয় আইন সভায় আলোচনার জন্য ওঠে। তারা বিচারপতি রাওলাটের এই খসড়াকে আইন হিসেবে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠা দেয়। পাকা হয়ে যায় মার্চ মাসের মধ্যে। ফলস্বরূপ, মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি আর শান্তির সময়, এক নয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও এই আইনকে রেখে দেওয়ার অর্থ; ভারতবাসীর প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের বিমাতৃ সুলভ মনোভাব।

#
রাওলাট আইনের সম্পূর্ণ নাম - The Anarchical and Revolutionary Act. আইনটিতে এমন কী ছিল যা ভারতবর্ষের মানুষকে প্রতিবাদে মুখর করে তোলে। আসলে এর প্রতিটি নির্দেশে ছিল ঔপনিবেশিক মনোভাব।
ক। বিনা পরোয়ানায় যে কোনো নাগরিককে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।
খ। যে কোনো স্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধ করতে পারবে সরকার এবং প্রত্যহ থানায় হাজিরার আদেশ দেওয়া যাবে।
গ। যে কোনো নাগরিকের কাছে প্রচুর টাকা সিকিউরিটি চাইতে পারবে সরকার।
ঘ। বিনা সাক্ষ্যে যে কোনো ব্যক্তিকে বিশেষ আদালতে দন্ড দেওয়া যাবে।
ঙ।। বিশেষ আদালত যে রায় দেবে তার ওপর কোনো আপীল গ্রাহ্য হবে না।
#
রাওলাট আইন সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যক্তিস্বার্থকে বিপন্ন করে। বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক আন্দোলন বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। গান্ধীজী খুব সংক্ষেপে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন, - "উকিল নেহি, দলিল নেহি, আপীল নেহি। "ডাঃ আনসারীর অভিমত অনুযায়ী গান্ধীজী ছিলেন হিন্দু - মুসলমান উভয় শ্রেণির নেতা। গান্ধীজী অন্য জাতীয় নেতাদের মত শহরমুখী আন্দোলন না করে তাকে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দেন। এর জন্য তিনি সত্যাগ্রহ সভা স্থাপন করে সত্যাগ্রহীদের কাছ থেকে
সত্যাগ্রহ করার জন্য সই সংগ্রহের অভিযান শুরু করেন। এমনকি রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে হোমরুল আন্দোলনকেও কাজে লাগান। গান্ধীজীর এই অনমনীয় মনোভাব সত্যাগ্রহীদের ভেতর উৎসাহ - উদ্দীপনা নিয়ে আসে। তারা সরকারী আইন ভেঙে ইংরেজ সরকারের কাছে ধরা দেন। গান্ধীজী এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি ৬ এপ্রিল, ১৯১৯ রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হরতাল পালনের ডাক দেন। হিন্দু - মুসলমান সম্প্রদায় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।
#
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়, -
·       লাহোরে হিন্দু - মুসলিম জনতা বাদশাহী মসজিদে গণ সমিতির হাতে শহরের শাসন তুলে দেয়।
·       পাঞ্জাবের সব জায়গায় হরতাল পালিত হয়।
·       স্বামী শ্রদ্ধানন্দের নেতৃত্বে দিল্লীর জামা মসজিদে হিন্দু - মুসলমান একত্র হয়ে হরতাল চালায়।
·       বোম্বাইতে, মাদ্রাজে হরতাল পালিত হয়।
·       কলকাতার নাখোদা মসজিদ থেকে হিন্দু - মুসলমানের মিছিল বা শোভাযাত্রায় মেশিনগানের গুলি চালায়।
·       সরকারের এই দমন রীতির বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা ৫১ টি সরকারী ভবন পুড়িয়ে ফেলে।
#
রাওলাট আইনের প্রতি প্রতিবাদ যত জোরালো হচ্ছিল, ততই মানুষের মধ্যে এর আবেগ ছুঁয়ে যেতে থাকে। তারা পরে কী হবে না ভেবে এই অন্যায় লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সেই আন্দোলন বা জনতার আগ্রহকে দমন করার জন্য নির্বিচারে গুলি বর্ষণ ও লাঠি চার্জ চলতে থাকে। গুজরানওয়ালায় বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। বর্ণ বৈষম্য চালু করে। সাদা চামড়া দেখলেই ভারতীয়দের ' সেলাম সাহেব ' বলতে আদেশ দেয় ব্রিটিশ সরকার।
#
রাওলাট আইন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা। অমৃতসরের জননেতা ডাঃ সৈফুদ্দিন কিচলু ও ডঃ সত্যপালকে গ্রেপ্তার করা হয়। অমৃতসরে ইতিপূর্বে ৩০ মার্চ ও ৬ এপ্রিল হরতাল হয়।এইরকম পরিস্থিতিতে ৯ এপ্রিল হিন্দু - মুসলমানের এক বিরাট শোভাযাত্রা বার হয়। উপলক্ষ রামনবমী। এইরকম এক মুহূর্তে ইংরেজ সেনাপতি জেনারেল ও'ডায়ার প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে দমননীতি গ্রহণ করেন। গান্ধীজীকে দিল্লি ও পাঞ্জাবে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়না। কিচলু এবং সত্যপালকে গ্রেপ্তার ও গান্ধীজীর ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে অমৃতসরের সাধারণ মানুষ ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে এক শান্তিপূর্ণ সভা করে। যদিও সভার ওপর আগে থেকেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন ও'ডায়ার। আসলে সেদিনের সভায় আগত মানুষগুলি ঐ নিষেধের কথা জানত না।
#
প্রায় দশ হাজার মানুষ ছোট্ট চারদিক ঘেরা এই উদ্যানে জড়ো হয়। ক্রোধে উন্মত্ত ও'ডায়ার ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালান। তার আগে উদ্যানের প্রবেশপথ আটকে দেওয়া হয়। ফলে জনতার পক্ষে বাইরে বার হওয়ার সমস্ত উপায় নষ্ট হয়। সরকারের হিসেব মত নিহত ৩৭৯ জন এবং আহত হন ১২০০ জন। সান্ধ্য আইন জারি করে আহতদের শুশ্রূষার সুযোগও কেড়ে নেওয়া হয়।
#
দেশজুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভারত সচিব মন্টেগু তাঁর মন্তব্যে যথার্থই বলেন - "...ও ' ডায়ারদের মতো কোনো লোককে বিনা বিচারে বন্দি করার সুযোগ করে দিতে আমি ঘৃণা করি। " স্যার সিডনি রাওলাটের সভাপতিত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট  সিডিশন কমিটি বা রাওলাট কমিটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৮ মার্চ, ১৯১৯; তা আরও বড়ো প্রতিরোধের মুখে পড়তে চলল এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার পরে।
#
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের জবানিতে শোনা যাক সেই ঘটনা।
“(..............) সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে - সাড়ে সাতটা,পৌনে আটটা হবে - কবি একটা ঠিকে গাড়িতে ফিরে এলেন। আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলুম। ..... পাঁচ সাত মিনিট কথা বলতে বলতেই দেখলুম, কবি খুব ক্লান্ত আর অন্যমনস্ক। জয়গোপালবাবু (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক) নিজেই উঠে পড়লেন। ... দেখলুম কবি খুব বিচলিত। কিছু না বলে চলে এলুম।
#
....রাত্রে ভালো ঘুম হলোনা। ভোর হয়নি - হয়ত চারটে হবে - উঠে স্নান করে বেড়িয়ে পড়লুম। .... জোড়াসাঁকোয় গিয়ে দেখি দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে। ... আমি ঘরে যেতেই মুখ ফিরিয়ে বললেন, কী এসেছো? এই বলে আবার লিখতে আরম্ভ করলেন। দু তিন মিনিট। তারপরেই একখানা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন পড়ো। বড়লাটকে লেখা নাইটহুড পরিত্যাগ করার চিঠি। আমি পড়লুম।
#
কবি তখন বললেন - সারারাত ঘুমাতে পারিনি। বাস্  এখন চুকলো। আমার যা করবার, তা হয়ে গিয়েছে। "
#
প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে কথোপকথনের সময় রবীন্দ্রনাথ দুজন নেতার নাম নেন। প্রথম জন মহাত্মা গান্ধী ও দ্বিতীয় জন চিত্তরঞ্জন দাশ। প্রথমে চিত্তরঞ্জনের কথা বলি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রতিবাদ সভা করতে বলেন। এবং নিজেই সভাপতি হবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। চিত্তরঞ্জন রাজি হন এবং একটু ভেবে বলেন যে কবির পরে আর কারোর বক্তৃতা দেওয়ার দরকার হয় না। রবীন্দ্রনাথ রাজি হলে চিত্তরঞ্জন দ্বিতীয় প্রস্তাব দেন। ' আপনি একা যখন বক্তৃতা দেবেন, আপনিই সভাপতি, তখন সব চেয়ে ভালো হয় শুধু আপনার নামে সভা - ডাকা। '
#
স্বাভাবিক ভাবেই চিত্তরঞ্জনের এই প্রস্তাব রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেননি। আর গান্ধীজী, দিল্লী আর পাঞ্জাবে প্রবেশ না করার জন্য সরকারের সেই আদেশ তিনি কি তখনো বহন করে চলছিলেন!
#
চিঠিটি ৩০ ( অথবা ৩১ মে), ১৯৯৯ লেখা হয়। এই নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। তবে যা নিয়ে প্রশ্ন নেই, তা হল কবির মনোভাব। অ্যান্ড্রুজ সাহেব রবীন্দ্রনাথকে চিঠির ভাষা একটু মোলায়েম করতে অনুরোধ করেন। কবি সাহেবের দিকে এমনি করে তাকিয়েছিলেন যা তিনি জীবনে ভুলতে পারবেন না কোনোদিন - "such a look as I had never seen in the eyes of Gurudev before or after!"
#
রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি সেদিন ভারতাত্মা কবির নির্ভীক ধিক্কার বাণী পৌঁছে দিয়েছিল ব্রিটিশ দরবারে।

গ্রন্থঋণ:
১। রবিজীবনি - প্রশান্তকুমার পাল
২। ভারতের ইতিহাস - প্রভাতাংশু মাইতি
৩। অন্তর্জাল

* ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত

1 comment:

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com