লুকোচুরি
[রচনা ও প্রথম অভিনয়: নরউইচ, ইংল্যান্ড, ২০১২]
চরিত্র
সুদীপা
।। গৃহবধূ, তৃষা ও রাহুলের মা
সৌমেন
।। সুদীপার স্বামী
তূষা
।। আট থেকে দশ বছর বয়সী
রাহুল
।। তৃষার ভাই, পাঁচ অথবাা ছয় বছর বয়স
তপতী
।। সুদীপার বান্ধবী, গৃহবধূ
চাঁপা
।। সুদীপার বাড়ির পরিচারিকা
কেয়া
।। সুদীপা-সৌমেনের পেয়িং গেস্ট
পার্থপ্রতিম
।। চাঁপার সম্ভাব্য প্রেমিক
পুলিশ
কন্ঠ ।। নেপথ্য চরিত্র
সৌমেন
সুদীপার বসার ঘর। একটা মাঝারি সাইজের টেবিল থাকলে ভালো হয়, দু-তিনটে চেয়ার। চারটে দরজার
আভাস থাকলে ভালো হয়, -- একটা রান্নাঘরের, একটি বাইরে যওয়ার, দুটি বেডরুমের, তার মধ্যে
একটি কেয়ার অন্যটি সুদীপা সৌমেনের।
সকাল
বেলা। স্বাভাবিক নিত্যকার ব্যস্ততা। সৌমেন
অফিস আর বাচ্ছারা ইস্কুল যাবার জন্যে তৈরী হচ্ছে। সুদীপা হিমসিম খাচ্ছে। কাজের মেয়ে
চাঁপা এখনো আসে নি। রাহুল একটা খেলনা এরোপ্লেন নিয়ে খেলার ছলে ঢোকে, আবার বেরিয়ে যায়।
সৌমেনের
মোবাইল ফোন বাজে।
সৌমেন:
বলো মুখার্জী, …. অ্যাঁ, আজকেও গাড়ির গন্ডোগোল। এভাবে আর চলে না। এবার অন্য গাড়ির ব্যবস্থা
করতে হবে। আর এ লোকটাও সেরকম।এক ঘন্টা আগে বল্, তা না ! …. ঠিক আছে তুমি তোমার মত চলে
যাও। …. বিকেলে? আমার দেরী হবে।…ওকে, বাই।
[
ফোন বন্ধ করে টেবিলে রেখে দেয় ]
সুদীপা:
আজকেও ট্যাক্সি ধরতে হবে?
সৌমেন:
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি করো।
সুদীপা:
এই ফর্দটা দিলাম। বিকেলে ফেরার পথে বাজার করে ফিরবে।
সৌমেন:
(ফর্দ হাতে নিয়ে, বিরক্ত) দু কিলো আলু, পাঁচ কিলো চাল, পাঁচশো বাতাসা – আচ্ছা এগুলো
তুমি নিজে গিয়ে কিনতে পারো না?
সুদীপা:
তাহলে সন্ধেবলা তুমি তৃষা রাহুলকে পড়াতে বসাবে। আর আমি বাজার যাবো।
সৌমেন:
সে আমি পারবো না। ঠিক আছে, বাজার করেই ফিরব।
সুদীপা:
( গলা নামিয়ে) আর শোনো, একটা কথা বলছি। এই পেয়িং গেস্টকে ছমাসের পর আর রাখবো না।
সৌমেন:
কেন, কী হলো আবার? দুটো পয়সা আসছে এই দুর্দিনের বাজারে …! কোন ঝামেলা তো নেই।
সুদীপা:
খাওয়া নিয়ে বড্ড খিটখট করে।
সৌমেন:
খাওয়া বলতে তো শুধু ব্রেকফাস্ট।
সুদীপা:
তা হলেই বা ! বড়লোকের মেয়ে তো, খুব পছন্দ অপছন্দ আছে।
সৌমেন:
ঠিক আছে, সে পরে দেখা যাবে। আচ্ছা শোন পুলিশ থেকে যদি ফোন করে, বা কেউ আসে--
সুদীপা: (ভয় খেয়ে) পুলিশ কেন?
সৌমেন:
পাসপোর্টের application-এ পুলিশ verification হবে না?
সুদীপা:
ও ! ফোন করলে কাকে করবে?
সৌমেন:
বাড়ির নম্বরটা দেওয়া আছে। তার মানে তোমার ফোনেই আসবে।
সুদীপা:
আচ্ছা, কী বলব?
সৌমেন:
(বিরক্ত) কী আর বলবে! বলবে আমি চোর, ক্রিমিনাল ।
সুদীপা:
অ্যাঁ ! [ তারপর ব্যঙ্গ বুঝতে পেরে] তা আমি কি পুলিশের সাথে কখনো কথা বলেছি?
সৌমেন:
ওরা এই নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে। আর বাড়িতে এলে একটু মিষ্টিজল খাইয়ে একশ টাকা হাতে
গুঁজে দেবে।
[
তৃষা রাহুল ঢোকে। তারা স্কুলের জন্যে প্রায় রেডি। তার মধ্যেই রাহুল এখনো এরোপ্লেন নিয়ে
মত্ত।]
তৃষা:
বাবা, আমার পরীক্ষা আছে আজ।
সৌমেন:
কী পরীক্ষা?
তৃষা:
জিওগ্রাফি
সৌমেন:
সেদিন জিওগ্রাফি দিলি না?
তৃষা:
সেটা তো ফার্স্ট ইউনট ছিল। আজ সেকেন্ড ইউনিট।
সৌমেন:
ও আমি ওত জানি না। দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাই তৃষা, বাই রাহুল।
[সৌমেন
বেরিয়ে যায়, তাড়াহুড়োতে মোবাইল ফেলে যায়।]
সুদীপা:
(চিৎকার করে) পরশু পেরেন্ট টিচার মিটিং আছে, ভুলো না কিন্তু।
সৌমেন:
(বাইরে থেকে, শ্লোগানের ভঙ্গিতে) ভুলি নি, ভুলব না,… ভুলি নি ভুলব না।
সুদীপা:
কোন জিনিসই সিরিয়াসলি নেবে না।
[এবার
সুদীপা ছেলে মেয়ের দিকে নজর দেয়। রাহুলের খেলা থামিয়ে তার টাই বাঁধতে থাকে। তৃষা পিঠে
ভারি ব্যাগ তুলতে হিমসিম খাচ্ছে ।]
সুদীপা:
কী বলেছি মনে আছে তো? (তৃষা ঘাড় নাড়ে) প্রত্যেকটা কোশ্চেন ভালো করে পড়বে। … রাজধানী
বলো।
তৃষা:
হায়দ্রাবাদ
সুদীপা:
তামিল নাড়ু
তৃষা:
চেন্নাই
[রাহুল
একটু ছাড়া পেয়েই এরোপ্লেন নিয়ে খেলা শুরু করে দেয়, মুখে পাউরুটি। টাই বাঁধা শেষ হয়
নি।]
সুদীপা:
কেরালা
তৃষা:
তিরুভা… তিরুভা…
সুদীপা:
বলেছিলাম না, এইটা শক্ত। দাঁড়া বইটা দেখি। (টেবিল থেকে বই খুলে) তিরুভান … তিরুভান…।
এটা কী রকম নাম রে বাবা ! মনে না পড়লে ওর পুরনো নামটা লিখি দিবি – তিরুপতি।
[তৃষা
মাথা নাড়ে।]
সুদীপা:
(রাহুলকে) বাবু, তোমার এখনো খাওয়া হলো না!
রাহুল:
না, …আমি পাইলট হবো…
সুদীপা:
পাইলট হতে গেলে স্কুল যেতে হবে, অনেক পড়তে হবে। এইটুকু খেলে চলবে?
রাহুল:
প্লেন চালিয়ে লন্ডন যাবো, প্যারিস যাবো…
[রাহুলের
পিছু পিছু দৌড়ে সুদীপা রাহুলকে থামায়। টাই বাঁধতে বাঁধতে..]
সুদীপা:
নার্শারী রাইমটা মনে আছে? … Mary had…
রাহুল:
a little lamb / Its fleece was white as snow….[রাহুল দৌড়াতে থাকে] পাইলট,
পাইলট আমি পাইলট আসছি সরে দাঁড়াও…
সুদীপা:
আরো দুটো লাইন বলো – কাল এত করে শেখালাম,… And everywhere that…
রাহুল:
(ভ্রূক্ষেপ নেই) Hello ATC London, …
তৃষা:
(এতক্ষণ বাইরের দিকে নজর রাখছিল) বাস এসে গেছে, বাস এসে গেছে .. চল্ চল্
[বাসের
আওয়াজ, রাহুল তৃষা সঙ্গে সঙ্গে তৈরী]
সুদীপা:
দাঁড়াও দাঁড়াও, … জলের বটল নাও। আমাকে হামি দাও। (রাহুলকে ধরে হামি নেয়) কী দুষ্টু
যে
হয়েছে না!
[
তৃষা রাহুল বেরিয়ে যায়। সুদীপাও ব্যস্তভাবে পিছু পিছু যায়। এই সময় ভেতর দিক বা মঞ্চের অন্য দিক থেকে কেয়া ঢোকে।
সুদীপার
গলা শোনা যায়: ব্যাগটা ঠিক করে নাও। ফিল আপ দ্য ব্ল্যাংকসগুলো আগে করবে।
কেয়া
খানিক আগেই ঘুম থেকে উঠেছে মনে হ্ছে। হাতে চা, টেবিল থেকে খবরের কাগজ তুলে নেয়, পাতা
উল্টায়। পাশে মোবাইল। ]
কেয়া
: (ফোন করে) কী, তুমি তৈরী ? যা বলেছিলাম মনে আছে তো ? ভেবে চিন্তে উত্তর দেবে, মাথা
গরম করবে না।…. না, আমি র কোন কথা শুনছি না। আর তোমার হয়ে গেলে একটা ফোন করবে। ঠিক
আছে তো? … রাখছি।
[সুদীপা
ঢোকে। ]
সুদীপা:
ও মা, তুমি উঠে পড়েছ? আমার তো এখনো ব্রেকফাস্ট বানানো হয় নি।
কেয়া:
খিদে নেই। আজ ব্রেকফাস্ট-টা প্যাক করে দেবেন, কলেজে নিয়ে যাবো।
সুদীপা:
কাল যে এরোপ্লেনটা তুমি এনে দিয়েছ, সেটা রাহুলের খুব পছন্দ হয়েছে।
কেয়া:
বাঃ খুব ভালো।
সুদীপা: কিন্তু সেটা নিয়ে খেলায় এত মত্ত যে পড়তেই বসল না।
কেয়া:
নাই বা পড়ল একদিন। ও তো কত ছোট এখন।
সুদীপা:
ছোট বললে হবে? পাশের বাড়ির অশোককে দেখো, ভোর থেকে উঠে পড়ছে। প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট।
সেই গরমে অশোকের মা-র মাটিতে পা পড়ে না।
কেয়া:
সবাই তো আর ফার্স্ট হবে না। ফার্স্ট তো একজনই হবে ।
সুদীপা:
তা অশোক হতে পারলে রাহুল কেন পারবে না? অত খেললে কি আর পারে? ছেলে মেয়ে মানুষ করা যে
কত শক্ত, তা তোমরা বুঝবে না।
কেয়া:
একদিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিড়িয়াখানা ঘুরে আসুন না, রাহুলের খুব মজা হবে।
সুদীপা:
গেলে হয়, কিন্তু তোমার দাদার সময় কোথায়? খালি কাজ আর কাজ।
কেয়া:
খালি অফিসের কাজটাই কাজ, আর এগুলো কাজ নয়?
সুদীপা:
ঠিকই বলেছ। তাছাড়া চিড়িয়াখানা গিয়ে জন্তু জানোয়ার দেখলে বায়োলজি পরীক্ষায় কাজে দেবে।
কেয়া:
শুধু চিড়িয়াখানা কেন, সায়েন্স সিটি, রবীন্দ্রসদন –
সুদীপা:
কোন্ সদন?
কেয়া:
রবীন্দ্রসদন
সুদীপা:
সেখানে কী হয়?
কেয়া:
গান হয়। তৃষাকে গান শেখান না? ওর গলাটা খুব মিষ্টি।
সুদীপা:
কী হবে গান শিখে? বড় হয়ে ও কি জলসায় গান গেয়ে বেড়াবে?
কেয়া:
কেন সেটা খারাপ কী?
সুদীপা:
কিছু মনে করো না ভাই। তুমি আসার পর থেকেই ওদের পড়াশোনায় ঢিলেমি এসে গেছে। আর বেশি বদবুদ্ধি
ওদের মাথায় ঢুকিও না। তৃষাকে আমি ডাক্তার করব, আর রাহুলকে ইঞ্জিনীয়ার। অশোকের মা এখন
থেকেই IIT-র খোঁজ নিচ্ছে, আর তুমি বলছ –
কেয়া:
ঠিকই তো, আমি বলার কে! দুদিনের পেয়িং গেস্ট, আপনার ছেলে মেয়ের ভালো মন্দ আমি আর কী
বুঝব।
[কেয়া
ঘরে ঢুকে যায়।]
সুদীপা:
(কেয়ার উদ্দেশ্যে) সে কথা নয়। তোমরা পড়াশোনার লাইনে আছো, তোমরা নিশ্চয় জানবে কী পড়লে
কী হয়। কিন্তু সংসার করার ত অভিজ্ঞতা নেই, তাই বলছিলাম….। যাই ব্রেকফাস্ট দেখি।
[সুদীপা
কিচেনের দিকে এগোতে থাকে। অন্যদিক দিয়ে চাঁপার প্রবেশ প্রায় নিঃশব্দে, সুদীপা লক্ষ্য
করে না।]
সুদীপা:
নটা বেজে গেল, চাঁপার এখনো আসার নাম নেই। এত কাজ, খাটতে খাটতে আমি মরে যাবো।
চাঁপা:
তুমি মরবে কি গো? একশো পার করে তবে মরবে।
সুদীপা:
(চাঁপার উপস্থিতি খেয়াল করে) কটা বাজছে খেয়াল আছে?
চাঁপা:
বনগাঁ লোকলে চেপেছ কখনো? চাপলে বুঝতে!
সুদীপা:
আটটায় আসার কথা এলি নটায়, তারপর বড় বড় কথা। তেমন তেমন মেয়ের হাতে পড়লে বুঝতিস কত ধানে
কত চাল।
চাঁপা:
বাব্বা সারাদিন এত কাজ করি, তবু তোমার মন ওঠে না।
[
চাঁপা টেবিলের জিনিসপত্র গোছায়, সুদীপা কিচেনে ব্যস্ত। টেবিলে রাখা সৌমেনের ফোন বেজে
ওঠে।]
চাঁপা:
বৌদি ফোন
সুদীপা:
(কিচেন থেকে) ধর
চাঁপা:
হ্যালো…। এক মিনিট। বৌদি দাদা অফিসে তো?
সুদীপা:
(কিচেন থেকে) হ্যাঁ
চাঁপা:
দাদা তো বেরিয়ে গেছেন।….আমি? না না আমি ওর বোন নই। ….আপনি কে? ঠিক আছে। [ফোন রেখে দেয়।]
সুদীপা:
(কিচেন থেকে) কার ফোন?
চাঁপা:
জানি না, নাম বলল না।
সুদীপা:
(কিচেন থেকে) তাহলে এত কথা কী বলছিলি?
চাঁপা:
দাদাকে খুঁজছিল – একটা মেয়ের গলা। এটা দাদার ফোন তো?
সুদীপা:
দেখি (বেরিয়ে আসে) , ওমা তাই তো! তোর দাদা আজ ফোন ভুলে গেছে। …নাম বলল না?
চাঁপা:
কেটে দিল তো।
সুদীপা:
হুঁ (একটু অবাক), নে ঘরটা একটু ঝাঁট দে তো।
[চাঁপা
একটা ঝাঁটা এনে ঝাঁট দিতে শুরু করে।]
চাঁপা:
এত ধুলো কোথা থেকে যে আসে, ভগবান জানে। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও এত ধুলো হয় না।
[সুদীপা
টিফিন বক্সে স্যান্ডউইচ ঢোকাতে থাকে।]
চাঁপা:
একটা কথা বলছি, কিছু মনে করো না বৌদি। আজকালকার দিনে আর কেউ ঝাঁটা দিয়ে ঘর সাফ করে
না। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার কিনতে হয়।
সুদীপা:
ভ্যাকুয়াম ক্লিনার? দিনের পর দিন তোর নবাবী যা বাড়ছে না! যদি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার কিনব,
তাহলে তোকে রাখবো কেন?
চাঁপা:
রাখবে, রাখবে। আমাকে ছাড়া তোমার চলবে না। এত কম টাকায় কে কাজ করবে?
[এই
সময় কেয়া বেড়িয়ে আসে, কলেজে যেতে তৈরী।]
চাঁপা:
ওমা, এই শাড়িটা তোমায় কী সুন্দর মানিয়েছে! কবে কিনলে গো?
কেয়া:
শাড়িটা ভালো হয়েছে বলছিস!
চাঁপা: খুব ভালো । তুমি যাই পরো তাই সুন্দর লাগে, সবার
তা নয় (সুদীপাকে কটাক্ষ করে) ।
কেয়া:
যা! তুই আবার বেশি বলছিস।
চাঁপা:
এর সঙ্গে যখন সানগ্লাসটা পরবে, যা লাগবে না।
তোমার সানগ্লাসটা একবার দেবে। একটু পরে দেখি, কেমন লাগে।
[কেয়া
ওর সানগ্লাস দেয়। চাঁপা সেটা পরে চারপাশে ঘোরে, বিশেষত সুদীপাকে দেখিয়ে দেখিয়ে। সুদীপা
বিরক্ত এবং আশ্চর্য। চাঁপাকে দিব্যি লাগছে।]
চাঁপা:
দিদি, আমাকে একটা শস্তার সানগ্লাস কিনে দেবে। বনগাঁয় এত রোদ হয়।
কেয়া:
ঠিক আছে দেব পরে। আমার ঘরটা একটু সাফ করে দিস। বাথরুমে জামা কাপড় ছাড়া আছে। কেচে দিস।
চাঁপা:
ও তুমি ভেবো না। কাল খাটের তলাটা পর্যন্ত ঝাঁট দিয়েছি। তোমার ঘর সাফ করতে আমার খুব
ভালো লাগে।
কেয়া:
আর বিছানাটা একটু গুছিয়ে রাখবি।
চাঁপা:
সে তোমায় বলতে হবে না।
সুদীপা:
তোর দিদির কাজ পরে করবি। সারাদিন সময় আছে। তোমার টিফিনটা ভাই।
কেয়া:
Thanks, কাল রাত্রে আমি ফিরব না, পরশু ফিরব।
সুদীপা:
আচ্ছা, আর আজ?
কেয়া:
আজ আছি।
চাঁপা:
বরুণদার সাথে বেড়াতে যাবে?
কেয়া:
তোর মাথায় সব সময় একই চিন্তা। তোর বরুণদা ছাড়া কোন কাজ নেই?
চাঁপা:
দুদিন বরণদাকে না দেখে থাকবে, মন খারাপ করবে না?
কেয়া:
না
চাঁপা:
আমার করত, আমি থাকতেই পারতাম না।
সুদীপা:
যা পেকেছিস নাা !
চাঁপা:
(সুদীপাকে) বরুণদাকে দেখেছ? কী হ্যান্ডসাম না?
সুদীপা:
কার বয়ফ্রেন্ড হ্যান্ডসাম, আর কারটা নয় – এসব দেখার সময় আমার নেই।
চাঁপা:
যখন বরুণদা তোমার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, তখন পাড়ার সব মেয়েরা দেখে।
সুদীপা:
আর তুই কী করিস?
চাঁপা:
আমি ভাবি কথা বলব, কিন্তু কী বলব ভেবে পাই না। বরুণদা যখন বলে,”তোমার দিদিকে ডেকে দাও”,
আমি কিছুই বলতে পারি না।
সুদীপা:
অতই যদি ছেলেদের সাথে কথা বলার ইচ্ছে, তাহলে একটা বয়ফ্রেন্ড যোগাড় কর্ না?
চাঁপা:
করবোই তো। তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে তোমার বাড়ির সামনে গল্প করব।
সুদীপা:
সরকারি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করবি কি কী করবি, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার বাড়িতে
না করলেই হলো।
চাঁপা:
আমার সঙ্গে করো, করো। তাই বলে কেয়াদির সঙ্গেও। সামনের বাড়ির বৌদি বলছিল,”ভদ্রলোককে
বাড়িতে বসাস না কেন? রোদে বৃষ্টিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।“ আমি বললাম,”সবাই তো আপনার
মত নয়।“
সুদীপা:
(ক্রূদ্ধ হয়ে চাঁপাকে) রাজ্যের লোকের কাছে আমার নামে কেচ্ছা করে বেড়ানো তোর স্বভাব।
(এবার কেয়াকে) কিছু মনে করো না ভাই। গোড়তেই বলে দিয়েছিলাম, পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকতে গেলে
কিছু নিয়ম কানুন মানতেই হবে। বয়ফ্রেন্ড বলো, ভাই বলো, বন্ধু বলো – ব্যাটাছলেকে ভেতরে
আনতে পারবে না।
[উত্তরের
অপেক্ষা না করেই সুদীপা বেরিয়ে যায়।]
কেয়া:
তুই এসব কথা কেন বলতে গেলি? জানিস তো তোর বৌদি এসব পছন্দ করে না।
চাঁপা:
আমি বলি কী দিদি, বেশিদিন এখানে আর থেকো না। বরুণদাকে নিয়ে সুন্দর একটা ফ্ল্যাটে উঠে
যাও।
কেয়া:
দাঁড়া আগে টাকা জমাই। ফ্ল্যাট কিনতে কত টাকা লাগে জানিস?
চাঁপা:
ততদিন বিয়ে না করে থাকবে?
কেয়া:
কী জানি কী করব?
চাঁপা:
তাহলে ভাড়া বাড়িতে থাকো।
কেয়া:
আজকাল বাড়ি ভাড়া পাওয়া খুব শক্ত। আর তোর বরুণদাকে তো জানিস না, খুব ভালো ফ্ল্যাট না
হলে সেখানে ঢুকবেই না।
চাঁপা:
বরুণদার টেস্ট খুব ভালো, বলো। তোমাকে যে শাড়িগুলো দেয়, কী সুন্দর। আর তোমরা যখন রাস্তা
দিয়ে যাও, সবাই মনে মনে ভাবে একটা কাপল যাচ্ছে বটে।
কেয়া:
তোর আবার বেশি বেশি।
চাঁপা:
ওরকম ছাড়া ছাড়া হাঁটবে না, হাত ধরে হাঁটবে।
কেয়া:
যা! আমাদের বয়স হয়ে গেছে। তুই যখন তোর বরকে নিয়ে হাঁটবি তখন করবি।
চাঁপা:
(হতাশার সুরে) আমার ওসব হবেই না। বিয়ে তো বাদ দাও বয়ফ্রেন্ডই হবে না।
কেয়া:
কেন হবে না? তুই কত সুন্দর জানিস! একটু সাজলে কত ভালো ভালো ছেলে আসবে।
চাঁপা:
সত্যি বলছ?
কেয়া:
একদম সত্যি।
চাঁপা:
জানি না। আমাদের জায়গাটা এমন না, একটাও ছেলে নেই, সব স্মাগলার।
কেয়া:
তাহলে তোকে আমাদের দুর্গাপুরে নিয়ে যাবো। ওখানে অনেক ভালো ছেলে আছে।
চাঁপা:
সত্যি বলছ? দারুণ হবে।
কেয়া:
খ্যাপা মেয়ে ! আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। (দুপাশ তাকিয়ে সুদীপার উদ্দেশ্যে জোর গলায়) এলাম
বৌদি।
[কেয়া
বেরিয়ে যায়। সুদীপা কোথায় বোঝা যাচ্ছে না। চাঁপা অন্যমনস্ক এবং ঘোরের মধ্যে আছে। টেবিলের
জিনিসপত্র গোছাতে থাকে। ]
চাঁপা:
(আবেশের মধ্যে) দুর্গাপুর… দারুণ হবে দুর্গাপুর….
[টেবিলে
মোবাইল বাজে।]
চাঁপা:
বৌদি, ফোন…, [সুদীপার কোন সাড়া নেই। চাঁপা অগত্যা ফোন ধরে।] হ্যালো… হ্যালো…
[মঞ্চের
এক কোণে আলোর বৃত্তে এক পুরুষ চরিত্র উপস্থিত হয় মোবাইল হাতে । বিকল্পে নেপথ্যকন্ঠ
ব্যবহার করা যাবে।]
পুরুষ
চরিত্র: (একটু ইতস্ততঃ) এটা সৌমেন ব্যানার্জীর ফোন তো?
চাঁপা:
হ্যাঁ । কিন্তু দাদা তো বেরিয়ে গেছেন।
পুরুষ
চরিত্র: ও! কিন্তু মোবাইলটা তাহলে…।
চাঁপা:
আজ মোবাইলটা উনি ভুলে গেছেন…।
পুরুষ
চরিত্র: তাই বলি! আমি দুর্গাপুরের অফিস থেকে ফোন করেছিলাম,… সৌমেনদা বলেছিল …
চাঁপা:
দুর্গাপুর থেকে ফোন করছেন, খুব ভালো।
পুরুষকন্ঠ:
কী ভালো?
চাঁপা:
এই দুর্গাপুর,… দুর্গাপুর থেকে ফোন –
পুরুষ
চরিত্র: দুর্গাপুর এমনিতে ভালো। কিন্তু সোশাল লাইফ নেই।
চাঁপা:
সোশাল লাইফের দরকার কী? একা একাই থাকবেন।
পুরুষকন্ঠ:
মানে আপনি কি একা থাকতে চান?
চাঁপা:
তা কেন? মনের মত লোক না পেলে একা থাকাই ভালো ।
পুরুষ
চরিত্র: আমিও তাই বলি। মনের মত লোক চাই। আচ্ছা, আপনি কি সৌমেনদার বোন?
চাঁপা:
অনেকটা বোনের মত। ছোট বোন বলতে পারেন। আপনি কি বৌদির সাথে কথা বলবেন?
পুরুষ
চরিত্র: না না সেরকম কিছু নয়। তাছাড়া উনি তো আমায় চিনবেন না – এই দেখুন কথা বলছি এতক্ষণ, অথচ আমার পরিচয়টাই দিই নি। আমি পার্থপ্রতিম।
চাঁপা:
কী সুন্দর নাম!
পুরুষ
চরি্ত্র: কেউ বলে পার্থ, কেউ বলে প্রতিম। আপনি কী বলবেন?
চাঁপা:
আমি! …আমি…তিম, .. শুধু তিম।
পার্থ:
আশ্চর্য, কোনদিন কেউ তো আমাকে ঐ নামে ডাকে নি। তিম… শুধু তিম…আপনি কী সুন্দর বললেন।
আচ্ছা, আপনার নামটা?
চাঁপা:
চাঁপা
পার্থ:
শুধু চাঁপা! আর কিছু নেই সঙ্গে?
চাঁপা:
একসময় ছিল, এখন নেই। স্বর্ণচাঁপা।
পার্থ:
কী সুন্দর নাম! স্বর্ণচাঁপা । আজকাল এসব নাম আর কেউ রাখে না।
চাঁপা:
ছোটবলায় মা ভেবেছিল বড় হলে আমি সোনা চাঁপার মত দেখতে হবো।
পার্থ:
আপনি কি সোনাচাঁপার মত দেখতে?
চাঁপা:
আপনি কি পার্থ-র ত দেখতে?
পার্থ:
কোন্ পার্থ?
চাঁপা:
কেন মহাভারত পড়েন নি? অর্জুনের আরেক নাম পার্থ।
পার্থ:
বাব্বা, আপনি অনেক জানেন তো। কলেজে পড়েন নিশ্চয়?
চাঁপা:
যদি বলি না
পার্থ:
বিশ্বাস করব না
চাঁপা:
করতে হবে না
পার্থ:
একটা কথা বলব? যদি কিছু মনে না করেন ন—
চাঁপা:
কী?
পার্থ:
আপনার ফোন নং দেবেন?
চাঁপা:
ইস্! ফোন নম্বর খোলামকুচি নাকি, চাইলেই পাবেন?
পার্থ:
(ঘাবড়ে গিয়ে) সরি, ভেরি সরি ….
চাঁপা:
হা হা হা…. লিখুন… 798324447
পার্থ:
ও!...447 …যা ভয় খাইয়ে দিয়েছিলেন
চাঁপা:
আপনি কিচ্ছু বোঝেন না
পার্থ:
হ্যাঁ,… না…মানে কখনো তো কারো ফোন নম্বর এভাবে চাই নি
চাঁপা:
তাই? সত্যি?
পার্থ:
তিন সত্যি।
চাঁপা:
ও মা!
পার্থ:
আচ্ছা, আপনাকে ফোন করা যাবে তো?
চাঁপা:
জনি না, কী করে বলব!
[হঠাৎ
সুদীপার গলা: কার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিস?]
চাঁপা:
এই যে ধরুন বৌদিকে দিচ্ছি।
[সুদীপা
প্রবেশ করেছে, হাতে ফোন নেয়।]
সুদীপা:
হ্যালো –
পার্থ:
বৌদি নমস্কার। আপনি চিনবেন না আমাকে । আমি দর্গাপুরের অফিস থেকে ফোন করেছিলাম। সৌমনদাকে
বলবেন কাল আবার ফোন করব।
সুদীপা:
তাই করুন। উনি তো আজ ফোনটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছেন।
পার্থ:
ধন্যবাদ
[ফোন
বন্ধ করে পার্থ অদৃশ্য হয়ে যায়।]
সুদীপা:
এতক্ষণ ধরে তুই কী কথা বলছিলি ?
চাঁপা:
আরে ওনার মামার বাড়ি বনগাঁয় আমাদের পাড়ায়। ওনার মামাতো বোনকে আমি চিনি। সেই কথাই হচ্ছিল।
সুদীপা:
ও! আচ্ছা, একবার নীচে গিয়ে লন্ড্রী থেকে তোর দাদার জামা প্যান্টগুলো নিয়ে আয় তো? দেরী
করবি না কিন্তু ।
চাঁপা:
আর পয়সা?
সুদীপা:
বলবি দাদা দিয়ে দেবে ।
[চাঁপা
‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে যায়। সুদীপা, ‘দেখি মাছটা ডিফ্রস্ট হলো কিনা ‘ বলতে বলতে কিচেনে
ঢুকে যায়। মঞ্চ খালি]
ঘন্টা
তিনেক পার হয়ে যায়। আবহ সঙ্গীত আলোর সাহায্যে এই সময় পার হওয়া বোঝানো যেতে পারে। সুদীপা
স্কুলের জামা কাপড় ইস্তিরী করছে। কলিং বেল বাজে।
সুদীপা:
চাঁপা দেখ তো। [ চাঁপার কোন সাড়া নেই।] কোথায় যে যায় ---
[সুদীপা
নিজেই গিয়ে দরজা খোলে।]
সুদীপা:
তুই! আয় । [তপতীর প্রবেশ] কী ব্যাপার রে, আজ রান্না নেই?
তপতী:
না। শাশুড়ি গেছে ছোট ননদের বাড়ি।আমার একার খাওয়া তো, কাল রাতের বিরিয়ানি পড়ে আছে, ঐগরম
করে খেয়ে নেব।
সুদীপা:
তাহলে আজ ছুটি?
তপতী:
বলতে পারিস। কিন্তু কালকে ফিরেই সুদেমূলে উসুল করে নেবে। তেমনি হয়েছে আমার ননদেরা,
সুযোগ পেলেই কানে বিষমন্ত্র দিচ্ছে।
সুদীপা:
তোর কত্তারও দোষ আছে।
তপতী:
দোষ নেই আবার! প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই মাতৃপূজা করা চাই তার । ‘মা, তোমার পায়ের ব্যথটা
কেমন।… আজ অম্বল হয় নি তো।‘ আর মা তো সুযোগের অপেক্ষায়, ‘পরের বাড়ির মেয়ে, যতটুকু করে
ততটুকুই মেনে নিতে হবে।‘
সুদীপা:
আমার শাশুড়িও কম নয়। সেদিন সৌমেনকে বলছে আমায় কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করা।
তপতী:
কী হয়েছে?
সুদীপা:
জানি না। বলে যখন তখন মাথা ঘোরে। সৌমেন বলেছে দুমাস অপেক্ষা করো, অফিসে অডিটের কাজ
শেষ হোক।
তপতী:
একা একা আছিস, ভালো আছিস। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে থাকা যে কী যন্ত্রণা।
সুদীপা:
তোর শাশুড়ির মাথায় একটু প্যাঁচ আছে।
তপতী:
প্যাঁচ মানে জিলিপির প্যাঁচ। কতদিন ধরে বলছি, বাড়িটা আপনার ছেলেকে লিখে দিন। তা দেবে
না। বলে মেয়েদেরও সমান ভাগ। বড় ননদ গয়নাগুলো হাতিয়ে সরে পড়েছে। ছোট ননদ বলে রেখেছে
একতলটা চাই। তাহলে দিন রাত বুড়ির সেবা করে আমি কী পেলাম?
সুদীপা:
ঠিক বলেছিস।
তপতী:
গত বছর যখন অ্যাপেনডিসাইটিস হলো,ভাবলাম মা কালী এবার মুখ তুলে তাকাবে। ও মা নার্সিং
হোম থেকে ফিরে এল দ্বিতীয় জীবন নিয়ে।
সুদীপা:
একটা কাজের লোক দ্যাখ, বুড়িকে সারাদিন দেখবে।
তপতী:
খুঁজছি তো, পাচ্ছি না।
[চাঁপা
এই সময় কিছু জামাকাপড় একটা বালতিতে নিয়ে ভিতর দিক থেকে আসে।]
চাঁপা:
বৌদি, কাপড়গুলো নীচ থেকে কেচে নিয়ে আসছি।
সুদীপা:
নীচে যাওয়া মানেই তো আড্ডা দেওয়া। সাবান নিয়েছিস?
চাঁপা:
তোমার সাবান শেষ, যা ছিল তাই নিয়েছি।
সুদীপা:
তোর হাতে দুদিন যেতে না যেতেই সাবান ফুরিয়ে যায়।
চাঁপা:
যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা বলি বৌদি। আজকাল আর কেউ সানলাইট দিয়ে কাপড় কাচে না।
অশোকের মা এরিয়েল দিয়ে কাচে। বলে অশোক তো ফার্স্ট বয়, ওর জামা একদম ফিটফাট থাকা দরকার।
সুদীপা:
মায়ের কাছে মাসির গল্প করিস না। অশোকের মা এরিয়েলের কোটোয় নিরমা ভরে রাখে, আর তোরা
ভাবিস এরিয়েল দিচ্ছে।
চাঁপা:
অত জানি না বাবা। তোমার সাবান ঘষতে ঘষতে আমার হাতে হাজা পড়ে গেল। সবার ঘরে এখন ওয়াশিং
মেসিন –
[চাঁপা
বেরিয়ে যায়।]
তপতী:
তোর এই ঝি-টার মুখ খুব।
সুদীপা:
মুখ বলে মুখ। তার উপর দিনরাত আস্কারা পাচ্ছে।
তপতী:
কার আস্কারা পাচ্ছে?
সুদীপা:
ঐ যে কেয়াদেবীর । ঐ একটা ঘর ঝাঁট দেয়, শাড়ি সায়া কাচে, তার জন্যে ১০০০, ভাবতে পরিস?
তপতী:
বলিস কী রে?
সুদীপা:
অত টাকা দেয় বলেই তো মাথায় উঠেছে।
তপতী:
তোর ঐ পেয়িং গেস্টটার খুব ঠাঁটবাঁট। এক এক দিন এক একটা শাড়ি। কত টাকা মাইনে পায়?
সুদীপা:
জানি না বাপু। আজকাল কলেজের মাস্টারদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিচ্ছে। বিয়ে টিয়ে করে নি—টাকাগুলো
এভাবেই ফুটোচ্ছে।
তপতী:
তৃষা রাহুল বড় হয়ে গেলে ওকে ছাড়িয়ে দিস।
[সৌমেনের
ফোন বাজে।]
সুদীপা:
এই হয়েছে জ্বালা। [ফোন অন করে।] হ্যালো … ও গৌতম… তোমার দাদা তো অফিসে, কেন তোমার সাথে
দেখা হয় নি?....সেকি!....তাহলে কোথাও বেরিয়েছে।… আচ্ছা দেখা হলে বলো দুর্গাপুর থেকে
কেউ ফোন করেছিল।…ঠিক আছে রাখছি। [ফোন রাখে।]
তপতী:
কার ফোন
সুদীপা:
গৌতম – সৌমেনের কলিগ। বললে সৌমেন অফিসে নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারছে না।
তপতী:
ফোন ছাড়া কোথাও কেউ গেলে চিন্তা হয়।
সুদীপা:
কিন্তু কোথায় যেতে পারে1 ও তো অফিস থেকে কাউকে না বলে কোথাও যায় না।
তপতী:
মোবাইলটা দ্যাখ না, কেউ ফোন করেছিল কি?
সুদীপা:
(একটু ভাবে) সকালে একটা ফোন এসেছিল – একটা মেয়ের ফোন। চাঁপা ধরেছিল, নাম বলে নি।
তপতী:
দ্যাখ না একবার কল ব্যাক করে।
সুদীপা:
না বাপু, আমি পারবো না, তুই কর।
তপতী:
(ফোন করে) সুইচ অফ করে রখেছে। দাঁড়া আর একটা জিনিস দেখি। (মোবাইল চেক করে।) একটা
SMS রয়েছে, ‘Come to Mainland China’.
সুদীপা:
তার মানে?
তপতী:
Mainland China-য় যেতে বলছে।
সুদীপা:
সৌমেনকে China যেতে বলবে কেন?
তপতী:
তা আমি কী করে জানবো? তোর বর তুই জানিস।
সুদীপা:
সৌমেন ইদানীং কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। বলছিল পাসপোর্ট করতে দিয়েছে। আমি ভাবলাম আজকাল
সবাই পাসপোর্ট করে, এর মধ্যে আর কী আছে?
তপতী:
বলিহারি বাবা! তোকে বলল পাসপোর্ট করছে, আর তুই চুপ করে রইলি। জিজ্ঞাসা করলি না পাসপোর্ট
নিয়ে কী করবে? কোথায় যাবে কেন যাবে?
সুদীপা:
অত কিছু তো আমার মাথায় আসে নি।
তপতী:
দাঁড়া যে মেসেজটা পাঠিয়েছে তাকে ফোন করি। [ফোন করে।] এটাও সুইচড অফ। হুম।
[চিন্তা
করে]
সুদীপা:
মেসেজটা ভালো করে পড় তো?
তপতী:
Come to Mainland China at 1 PM, KR… KR কে জানিস?
সুদীপা:
KR… KR... জানি না।
তপতী:
দাঁড়া দাঁড়া এবার মনে পড়েছে Mainland China একটা রেস্টুরেন্ট, এলগিন রোডে।
সুদীপা:
সৌমেন অফিস না করে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে, আশ্চর্যের ব্যপার।
[এই
সময় সুদীপার ফোন বাজে।]
সুদীপা:
(বিরক্ত, অচেনা নম্বর) এই সময় কারা ফোন করে? হ্যালো –
কন্ঠ:
আপনি কে বলছেন?
সুদীপা:
আপনি কে?
কন্ঠ:
পুলিশের গলা শুনে বুঝতে পারেন না?
সুদীপা:
পুলিশ! পুলিশ কেন?
পুলিশ
কন্ঠ: সে ত আপনিই ভালো জানবেন।
সুদীপা:
(খুবই নার্ভাস) জানি না,… কারো কিছু হয়েছে?
পুলিশ
কন্ঠ: অত ভয় খাবার কিছু নেই। পাসপোর্টের জন্যে দরখাস্ত করেছেন?
সুদীপা:
(হঠাৎ খেয়াল হয়) হ্যাঁ.. হ্যাঁ..
পুলিশ
কন্ঠ: সোমেন ব্যানার্জী আপনার নাম?
সুদীপা:
না না, সুদীপা ব্যানার্জী
পুলিশ
কন্ঠ: তাহলে সোমেন লিখেছেন কেন?
সুদীপা:
সোমেন নয়, সৌমেন ব্যানার্জী আমার হাজবেন্ড –
পুলিশ
কন্ঠ: আচ্ছা সোমেনবাবুকে কতদিন চেনেন?
সুদীপা:
বিয়ের সময় থেকে।
পুলিশ
কন্ঠ: কত বছর?
সুদীপা:
তা ..দশ বছর
পুলিশ
কন্ঠ: সোমেনবাবু কি বাড়িতে আছেন?
সুদীপা:
না তো, সোমেন নয়, সৌমেনবাবু
পুলিশ
কন্ঠ: কোথায় তাহলে, অফিসে?
সুদীপা:
হ্যাঁ,… না না অফিসেও নেই। China-তে আছে?
পুলিশ
কন্ঠ: সব্বোনাশ! ওনার এখনো পাসপোর্ট হয় নি, এদিকে China চলে গেছেন?
সুদীপা:
কেন, কী হবে?
পুলিশ
কন্ঠ: সি বি আই হয়ে যাবে! এটা পুরোপুরি ইললিগাল – পাসপোর্ট ছাড়া আপনি দেশের বাইরে যেতে
পারেন না।
[এই
সময় তপতী পাশ থেকে ইশারা করে।]
সুদীপা:
এ China সে China নয়। এটা একটা China নামের রেসটুরেন্ট।
পুলিশ
কন্ঠ: ও, মানে হোটেলে খেতে গেছেন। আগে বলবেন তো।
সুদীপা:
হ্যাঁ, সরি…
পুলিশ
কন্ঠ: আচ্ছা ভোটার আই ডি, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড , ম্যারেজ সার্টিফিকেট আর যা যা
আছে সব নিয়ে পরশু আসতে বলবেন ।
সুদীপা:
কিন্তু পরশু যে স্কুলে পেরেন্ট টিচার মিটিং আছে –।
পুলিশ
কন্ঠ: সেসব আমরা জানি না। তিলজলা পুলিশ স্টেশনে
সব ডকুমেৃন্ট নিয়ে যেন হাজিরা দেন।
সুদীপা:
পুলিশ স্টেশনটা কোথায়?
পুলিশ
কন্ঠ: তিলজলায়। [ফোন কেটে দেয়।]
সুদীপা:
কী জ্বালা বল্ দেখি!
তপতী:
হুম্! তোকে না বলে রেস্টরেন্টে গেল, অফিসেও কেউ জানলো না। কে এই KR?
সুদীপা:
আমিও তাই ভাবছি, কে হতে পারে! K দিয়ে তো ওর
কোন বন্ধু নেই।
তপতী:
শুধু বন্ধু দেখলে চলবে, আরো অনেক কিছু দেখতে হবে।
সুদীপা:
মানে?
তপতী:
মানে, লুকিয়ে লুকিয়ে কারো সাথে কিছু করছে না তো ?
সুদীপা:
যাঃ, হতেই পারে না!
তপতী:
কী করে জানছিস তুই? পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই। যখন অফিস থেকে ফিরবে , লুকিয়ে লুকিয়ে
জামা কাপড়, মোবাইল, মানিব্যাগ সব চেক করতে হবে।
সুদীপা:
ছি! ওসব কেউ করে নাকি?
তপতী:
আমি করি। লজ্জার কী আছে এর মধ্যে?
সুদীপা:
যদি জানতে পারে আমি অবিশ্বাস করছি, তাহলে কী ভাববে?
তপতী:
জানলে তবে তো ভাববে। জানতেই পারবে না।
সুদীপা:
যদি জানে --?
তপতী:
জানলে জানবে! ছেলেরা ধরেই নেয় বৌরা তাদের ওপর নজরদারি করবে। আচ্ছা বল্ তো, সৌমেনদা
কখন ফেরে?
সুদীপা:
তা রাত্রি ... আটটা, কখনো নটা। বলে কাজ আর কাজ। প্রোমোশন পাওয়ার পর কাজ যেন আরো বেড়েছে।
তপতী:
ভেবে দেখ্, তাই কখনো হতে পারে? যত প্রোমোশন হবে তত কাজ কমবে। ও নিশ্চয় অফিস ছুটির পর
কোথাও যায়, নয়ত অফিসেই কারোর সাথে কাজের নামে –
সুদীপা:
আর বলিস না বাবা, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে !
তপতী:
তবে একটা কথা জানবি। যত বড় অপরাধীই হোক, সে clue রেখে যাবেই।
সুদীপা:
তার মানে?
তপতী:
মানে, তার নাম KR, এইটা একটা clue; এখন খুঁজে বের করতে হবে কে এই KR ….
[দুজনে
ভাবতে ভাবতে পায়চারি করে।]
সুদীপা:
ওদের অফিসে এক মিসেস খৈতান আছে
তপতী:
সে কি শয়তান টাইপের?
সুদীপা:
না না খুব ভালো, মাসি মাসি দেখতে।
তপতী:
ধুস্, তাহলে তার কথা বলছিস কেন?
সুদীপা:
তুই তো বললি ‘ক’ দিয়ে নাম এমন কেউ আছে কিনা?
তপতী:
হ্যাঁ, কিন্তু তার বয়স একটু কম হতে হবে। বিয়ে হয় নি, অথচ হওয়া উচিত ছিল, অফিসে কাজ
করে – এইরকম কেউ।
সুদীপা:
আমার মাথা ঘুরছে, আমি চিন্তা করতে পারছি না।
তপতী: ঠিক আছে, তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ‘ক’
দিয়ে যত নাম হতে পারে বলে যাচ্ছি, তুই চেনা পেলেই থামাবি, ঠিক আছে? [ সুদীপা মাথা নাড়ে
] কাকলী … কাবেরী… কবিতা –
সুদীপা:
ওর এক কবিতা বৌদি আছে, সিমলায় থাকে ।
তপতী:
ধুস্!... কাজল… করবী…কেয়া…
সুদীপা:
[হঠাৎ যেন আবিষ্কার করে ] কেয়া, কেয়া রায় – KR !
তপতী:
সর্বনাশ ! মানে তোর পেয়িং গেস্ট কেয়া রায় ?
সুদীপা:
[মুচড়ে পড়ে] কিন্তু … ওর তো বয়ফ্রেন্ড আছে !
তপতী:
কী করে জানলি তুই ?
সুদীপা:
চাঁপা বলে যে
তপতী:
সেও যে এরিয়লের কৌটোয় সানলাইট রাখার মত নয়, কে বলতে পারে !
সুদীপা:
(ভেঙে পড়ে) ও মা, আমার কী হবে এখন?
তপতী:
শোন্, আমরাও ঐ China রেস্টুরেন্টে যাবো ।
সুদীপা:
গিয়ে --?
তপতী:
হাতে নাতে ধরবো।
সুদীপা:
ধরে --?
তপতী:
কেয়া রায়কে বুঝিয়ে দেবো, মধু খেতে হলে অন্য বাগানে যাও।
[চাঁপার
প্রবেশ ]
চাঁপা:
বৌদি, ছাদে কাপড়গুলো মেলে এলাম।
[চাঁপা
ভেতরে ঢুকে যায়। নেপথ্য থেকে তার গলা শোনা যাবে।]
সুদীপা:
(চাঁপাকে) হ্যাঁ রে, তোর কেয়াদি আজ কোথায় যাবে কিছু জানিস ?
চাঁপা:
কেন কলেজে ? যেমন যায়।
সুদীপা:
তারপর কলেজ থেকে? মানে কোথাও খেতে টেতে যেতে পারে না?
চাঁপা:
তা আমি জানি না। তবে কেয়াদি মঝে মাঝে চাইনিজ খেতে যায়।
তপতী:
সর্বনাশ ! আর বসে থাকিস না।
চাঁপা:
কেন কী হলো গো?
সুদীপা:
কিছু না। (ব্যাগ গোছাতে গোছাতে) তুই ওদেরকে বাস থেকে এনে পড়তে বসাবি। আমরা একটু বেরুচ্ছি
। তুই রান্নাগুলো দেখবি।
[সুদীপা
তপতী বেরুতে উদ্যত, চাঁপা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে।]
চাঁপা:
একটা কথা বলি, যদি কিছু মনে না করো বৌদি।
সুদীপা:
(খুবই বিরক্ত) বল্ না ! মনে না করার মত কথা কোন দিন বলেছিস?
চাঁপা:
না বলছিলাম, আজকালকার দিনে একটা মাইক্রো ওভেন না কিনলে রান্না ভালো হয় না। অশোকের মা
বলছিল –
সুদীপা:
থাক থাক আর শুনতে চাই না। মাইক্রো ওভেন চাই –
[তপতী
ও সুদীপা বেরিয়ে যায়। চাঁপা ঘরের মধ্যে ঘুরতে
থাকে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে। ]
চাঁপা:
তখন বলল ফোন করবে, এখনো করলো না তো ! দেবো একটা মিস কল? না বাব কী ভাববে ! … ভাবুক
না! …. দিই…. (ফোনের button টেপে)
[দুবার
রিং হয়। চাঁপা ফোন কেটে দেয়।]
চাঁপা:
নামটা খুব ভালো। পার্থ , প্রতিম, তিম – তিনটে নামই ভালো। যখন যেটা খুশি বলব … (স্বপ্নের
ঘোরে, আলো কমে আসতে পারে) আমাদের একটা ছোট্ট ঘর হবে। উঠুনে ফুলের গাছ –রজনীগন্ধা, কাঠালীচাঁপা,
গোলাপ কত কী! সকালবেলা এইখানে রোদ এসে পড়বে, আর আমি খোঁপায় ফুল গুঁজে ঐখানে এসে দাঁড়াব।
তুমি বলবে স্বর্ণলতা । আমি বলব, না আজ শিউলি বলে ডাকো, কাল বলবে দোলনচাঁপা, পরশু বলবে
…
[চাঁপার
গলা ছাপিয়ে শোনা যায় ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানটি বা ঐরকম কিছু । বোঝা যায় চাঁপা স্বপ্ন
দেখছে। প্রায় নিঃশব্দে পার্থর প্রবেশ। খুব কাছে আসে, চাঁপা বুঝতে পারে না।]
পার্থ:
জেগে আছো, মাধবীলতা?
চাঁপা:
(চমকে ওঠে) কে? ও তুমি? আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে!
পার্থ:
থাকতে পারলাম না। ভাবলাম যদি বিকেলে মাধবীলতার ফুলগুলো শুকিয়ে যায়।
চাঁপা:
তো কী দেখলে ?
পার্থ:
দেখলাম আমার মাধবীলতা ভোরের মতই ফুটফুটে।
চাঁপা:
মিথ্যে কথা
পার্থ:
মায়ের দিব্যি বলছি।
চাঁপা:
ইস্, মরা মায়ের নামে গালা দিব্যির কোন জোরই নেই।
পার্থ:
তাও তো বটে। আচ্ছা, তাহলে আমার দিব্যি।
চাঁপা:
না, না। কক্ষনো না। তোমার নামে কখনো দিব্যি গালবে না।
পার্থ:
বেশ তাই হবে। আচ্ছা শোন যেকথা তোমায় বলতে এলাম আমাদের অফিস থেকে পিকনিক যাবে, অযোধ্যা
পাহাড়ে। তুমি তো পাহাড়ে কখনো যাও নি, তাই না?
চাঁপা:
না
পার্থ:
খুব ভালো লাগবে তোমার।
চাঁপা:
কিন্তু যদি আমাদের না ডাকে?
পার্থ:
কেন দেবে না?
চাঁপা:
আমরা তো অফিসারের বৌ নই ।
পার্থ:
ও, তাও তো বটে। (একটু ভাবে) তা যদি হয়, তাহলে আমরা দুজনে অন্য কোথাও যাবো।
চাঁপা:
খুব ভালো হবে।… আমরা কোথায় যাবো?
পার্থ:
কোথায় যাবো…কোথায় যাবো….! শোন আমরা যে কোন একটা ট্রেন ধরবো। তারপর…
চাঁপা:
দারুণ হবে। তারপর…?
পার্থ:
তিন ঘন্টা আমরা যাবো…
চাঁপা:
মাত্র তিন ঘন্টা? না, না চার ঘন্টা, না পাঁচ ঘন্টা যাবো…
পার্থ:
ঠিক আছে পাঁচ ঘন্টাই যাবো। তারপর যেখানে গিয়ে থামবো সেখানে যদি পাহাড় থাকে –
চাঁপা:
যদি পাহাড় থাকে –
পার্থ:
আমরা ঝরনার কাছে গিয়ে বসে থাকবো।
চাঁপা:
যদি পাহাড় না থাকে, যদি আমরা নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছাই –
পার্থ:
তাহলে আমরা একটা নৌকোয় চেপে খালি এপার আর ওপার করবো।
চাঁপা:
ভীষণ মজা হবে। সেই নদীর ঘাটে একটা ছোট্ট খাবার দোকান, আমরাই তার একমাত্র খদ্দের। তার
পাশে কাঠবিড়ালি ঘুড়ে বেড়ায়। আর বাঁশের উপর
একটা দোয়েল পাখি কারো জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
[পার্থর
ফোন বাজে।]
পার্থ;
হ্যালো…. ইয়েস স্যার…, নো স্যার… ম্যাডামের ট্রেন লেটে রান করছে স্যার… আমি স্টেশনেই
দাঁড়িয়ে আছি স্যার।… okay স্যার…নো প্রবলেম স্যার।
[ফোন
অফ করে।]
চাঁপা:
কী হলো?
পার্থ:
আমাকে এখুনি স্টেশনে যেতে হবে, স্যারের বৌ আসছে যে।
চাঁপা:
ও!
পার্থ:
লক্ষীটি রাগ করো না। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি যাবো আর আসবো, এসে তোমায় চা করে খাওয়াবো,
সঙ্গে গরম চপ।
[পার্থ
বেরিয়ে যায়। চাঁপা টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে আলো উজ্জ্বল হয়। সময় অতিক্রান্ত
হয়েছে বোঝা যায়।]
[কেয়ার
প্রবেশ। চাঁপাকে ঘুমোতে দেখে কাছে এসে গায়ে হাত দেয়।]
কেয়া:
এই চাঁপা, চাঁপা,… ওঠ্
চাঁপা:
(ধড়মড় করে ওঠে) ওমা! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কটা
বাজছে গো?
কেয়া:
সাড়ে তিনটে
চাঁপা:
ও! তুমি চলে এলে এত তাড়াতাড়ি?
কেয়া:
একটা ভালো খবর আছে, তোকে বলব বলে চলে এলাম।
চাঁপা:
কী গো?
কেয়া:
তোর বরুণদার একটা চাকরি হয়েছে।
চাঁপা:
মানে এতদিন --?
কেয়া:
তোর বরুণদা বেকার ছিল।
চাঁপা:
তাহলে?
কেয়া:
তোর বরুণদাকে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। এত শৌখীন মানুষ, সবসময় ফিটফাট থাকবে।
চাঁপা:
খুব বড় চাকরি নিশ্চয়?
কেয়া:
না, মোটামুটি। তোর বরুণদা এতদিন বড় চাকরি না পেলে করবে না বলে জেদ করে বসেছিল। এবারে
আমি আর কিছু শুনি নি, বলেছি যেমন হোক চাকরি, আর বাদ বিচার করা চলবে না।
চাঁপা:
তোমরা তাহলে বিয়ে করতে পারবে এবার?
কেয়া:
হ্যাঁ
চাঁপা:
কবে গো, কবে গো?
কেয়া:
দাঁড়া, আগে এই বাড়িটা ছাড়ি। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া খুঁজতে হবে তো।
চাঁপা:
ফ্ল্যাট কিনবে না? একটা বড় ফ্ল্যাট –
কেয়া:
ধুর্ খেপী, ওসব কবে হবে কে জানে!
চাঁপা:
তোমাদের বাড়িতে অন্য কাউকে কাজে রাখতে পারবে না। আমি আসবো কাজ করতে।
কেয়া:
কী কাজ করবি?
চাঁপা:
এই ঘর দোর সাফ করব। বাগান থেকে ফুল তুলে এনে – ও, তোমাদের তো আবার বাগান থাকবে না,
ব্যালকনিতে ফুলের টব থাকবে, -- ফুল এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখবো।
কেয়া:
সে তো আমিও করতে পারি । কাজ না করে যদি বসে থাকি, দুদিনে মোটা হয়ে যাবো।
চাঁপা:
যাঃ, তুমি কোনদিন মোটা হবে না।
কেয়া:
তুই আমার বাড়িতে কাজ করতে আসবি কেন? এমনি আসবি – ছুটির দিনে তোর বরকে নিয়ে, রাত্রে
ডিনার খেয়ে বাড়ি ফিরবি।
চাঁপা:
সত্যি বলছো ! বিয়েটা যে কবে হবে। (দীর্ঘনিঃশ্বাস)
[চাঁপার
ফোন বাজে। নাম্বার দেখে চাঁপা উল্লসিত। মঞ্চের অন্য প্রান্তে পার্থকে দেখা যায়। ]
চাঁপা:
হ্যালো…
পার্থ:
মিসড্ কল দিয়েছিলেন?
চাঁপা:
হবে হয়ত, মনে নেই। ফোন করেন নি তো?
পার্থ:
করতাম তো।
চাঁপা:
খুব হয়েছে !
কেয়া:
কার ফোন রে?
চাঁপা:
(ফোনে হাত চেপে) তুমি চিনবে না, দুর্গাপুরের
একজন।
কেয়া:
বাব্বা এর মধ্যে তুই দুর্গাপুর চলে গেলি কী করে?
পার্থ:
আপনার সঙ্গে কেউ রয়েছে?
চাঁপা:
আমার দিদি
পার্থ:
আপনার নিজের দিদি?
চাঁপা:
একরকম। আমার বড়দি, কলেজে পড়ান।
পার্থ:
বাব্বা, আমাদের ফ্যামিলি তো খুব এডুকেটেড। আচ্ছা এখন রাখি তাহলে। পঁচটার পর ফোন করব।
চাঁপা:
না, না। তখন তো আমি বনগাঁ লোকালে। ছটার পর ফোন করুন।
পার্থ:
ও, এখন তাহলে কোথায়, অফিসে?
চাঁপা:
এটাকে তো ঠিক অফিস বলা যায় না। আমার কাজের জায়গা, কাজ সেরে ফিরব। তারপর সন্ধেবেলা আপনাকে
একটা মিস কল দেবো, তখন ফোন করবেন।
পার্থ:
এখন ছাড়ছি তাহলে।
চাঁপা:
হ্যাঁ বাই
[পার্থ
অদৃশ্য হয়ে যায়। চাঁপা ফোন রাখে। কেয়া রীতিমত হতভম্ব।]
কেয়া: কী ব্যাপার রে ?
চাঁপা:
সে অনেক কথা…
কেয়া:
শুনি শুনি…
চাঁপা:
তবে শোনো –
[সঙ্গীত
বেজে উঠে চাঁপা ও কেয়ার গলা ঢেকে দেয়। বোঝা যাচ্ছে চাঁপা কেয়াকে তার গল্প শোনাচ্ছে।
৪০ থেকে পঞ্চাশ সেকেন্ড বাজানো যেতে পারে।]
কেয়া:
বাব্বা তুই পারিসও বটে !
চাঁপা:
খুব ভালো হবে ছেলেটা, কী বলো, তোমাদের দুর্গাপুরের ছেলে !
কেয়া:
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর যখন ভালো লেগেছে, তখন সে নিশ্চয় ভালো ছেলে।
চাঁপা:
(ঘড়ি দেখে) ও মা বাস আসার সময় হয়ে গেছে। আমি এক্ষুনি আসছি।
[চাঁপা
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। কেয়া ফোন করে।]
কেয়া:
মা, ঘুমোচ্ছিলে?...একটা খবর আছে মা, …বরুণের একটা চাকরি হয়েছে।….না, বাবাকে খুশি করার
মতো কিছু নয়, তবু বাবাকে বোলো। আমাদের বিয়েতে যদি তোমরা আসো খুব খুশি হবো। … না এখনো
বিয়ের দিন ঠিক করি নি।…. বরুণ বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করে, সেটা বাবা যদি বুঝতো। …তুমি
একটু বাবাকে বুঝিয়ে বোলো বরুণ খুব খারাপ নয়।…..জানি মা, আমার জন্যে তোমরা কত পাত্র
দেখেছিলে – ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, MBA….বরুণ তাদের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু বরুণকে যে
আমি ভালবাসি মা ….বরুণকে আমি ভালবাসি…
[ফোন
শেষ হয়, কেয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে। ব্যাকগ্রাউন্ডে সঙ্গীত বাজে। অঞ্জন
দত্তের ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো,
এটা কি 2441139?’ গানটি বাজানোর সাজেশন রইল।]
[আস্তে আস্তে কেয়া নজেকে সংযত করে। গান শেষ হয়। চাঁপা তষা ও
রাহুলকে নিয়ে ঢোকে। রাহুল কাঁদছে।]
কেয়া: কী হলো রাহুল? কাঁদছো কেন বাবা?
রাহুল: আমার এরোপ্লেনটা ভেঙে গেছে (কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা প্লেনটা
দেখায়)।
কেয়া: কী হয়েছে তাতে? কত বড় বড় প্লেন ভঙে পড়ছে, তোমারটা তো ছোট
প্লেন ।
তৃষা: মা তোকে খুব বকবে। প্লেনটা কেন স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলি?
কেয়া: তোমাকে আর একটা প্লেন কিনে দেবো।
রাহুল: প্লেন নয়, একটা গাড়ি কিনে দবে, ফরমুলা ওয়ান।
কেয়া: ঠিক আছেৃ তাই দেবো।
চাঁপা: যাও তোমরা হাত পা ধুয়ে খেতে বসো, তারপর পড়তে বসবে।
তৃষা: এখন আমি পড়ব না। মা কোথায়?
চাঁপা: বেরিয়েছে
তৃষা: মাকে বোলো না, আমার দুটো প্রশ্ন ভুল হয়েছে।
চাঁপা: কিন্তু মা তো জানতে পারবেই।
তৃষা: জানুক গে, মা যদি নিজে পরীক্ষা দিত বুঝতো।
কেয়া: ঠিক বলেছিস।
তৃষা: আমাদের স্কুলে আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হবে, আমি নাম দেবো।
চাঁপা: আবৃত্তি? মানে কবিতা বলা? আমি একটা কবিতা জানি।
তৃষা: বলো, বলো
চাঁপা: আমাদের ছোট নদী…
তৃষা: ঐটা তো সবাই জানে, ---
তূষা ও চাঁপা: আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু
জল থাকে…
তৃষা: (একা) পার হয়ে যয় গরু, পার হয় গাড়ি
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নেই কাদা
একধারে
কাশবন ফুলে ফুলে সাদা ।
রাহুল: (মন দিয়ে শুনছিল) গরু কী করে? গাড়ি চালায়?
কেয়া: হ্যাঁ গরু গাড়ি চালায়, ঘাস খায়, দুধ দেয় – অনেক কিছু করে।
তৃষা: (কেয়াকে) ও পিসি, একটা গান শেখাও না।
চাঁপা: ওমা, পড়তে বসবে না?
তৃষা: না, আজ ছুটি
রাহুল: (দৌড়াতে থাকে ) ছুটি… ছুটি…ছুটি…
কেয়া: তাহলে একটা ছুটির গান করি।
‘মেঘের কোলে
রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি
আ
হা হা হা।
আজ আমাদের
ছুটি , ও ভাই, আজ আাদের ছুটি
আ
হা হা হা ।‘
[তৃষা গলা মেলায় কেয়ার সাথে। নেপথ্যেও গানটি বাজানো যেতে পারে,
এবং সবাই মিলেই হালকা নাচের সাথে গানটি করতে পারে।]
[হঠাৎ চাঁপার খেয়াল হয় সুদীপা আসছে।]
চাঁপা: বৌদি আসছে। [গান থেমে যায়।] সাই লুকিয়ে পড়ো।
[চারজনে ভেতরে চলে যায়।]
[সুদীপা, তপতী ও সৌমেন আসে। সবাই শ খুশীর মেজজে। ]
সৌমেন: এবার বলো তো, ব্যাপারটা কার মাথায় এসেছিল?
তপতী ও সুদীপা: (একসঙ্গে) ওর [একে অপরকে দেখায়।]
সৌমেন: একটা SMS এলো আর তোমরা ভাবলে –
সুদীপা: তুমি ফোন ভুলে যাও কেন?
তপতী: তবে আপনার বন্ধু কৌশিক রায় যেমনি বড়লোক, তেমনি দলদরিয়া।
(সুদীপাকে) কত টাকার বিল উঠেছিল দেখলি?
সুদীপা: কত?
তপতী: পাঁচ হাজার
সুদীপা: ওরে বাবা ! শুনলে আর খাবার হজম হবে না।
সৌমেন: কৌশিক ছোটবেলার বন্ধু, এখন মুম্বাইতে থাকে, অনেকদিন দেখা
হয় নি। কলকাতা এসেছে, বলল, বৌকে নিয়ে চলে আয়, একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। তা আমি আর তোমকে
বলি নি, তোমার আবার দুপুরের ঘুম নষ্ট হবে।
তপতী: ভালোই হলো। এত বড় রেস্টুরেন্টে তো কখনো যেতে পারবো না। যাই হোক, আমি চলি বুঝলি, আমার কত্তার আবার আসার
সময় হয়ে এল।
সুদীপা: বেশ আয় তবে।
[তপতী চলে যায়।]
[এই সময় রাহুল ঢোকে, হাতে একটা লাঠি নিয়ে ‘আমি গরু চরাবো, আমি
গরু চরাবো’ বলে ঘুরপাক খেতে থাকে।]
সুদীপা: ছিঃ, এসব কথা কোথায় শিখলি?
[সৌমেন কিন্তু মজা পায়।]
সৌমেন: (রাহুলকে থামিয়ে) গরু চরাবি, খুব ভালো কথা। তাহলে তো
একটা গরু কিনতে হয়।
রাহুল: বাবা, বাবা তুমি গরু হবে ? আমি তোমার পিঠে চরবো।
[সৌমেন হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে গরুর মত হাঁটে। রাহুল পিঠে চেপে
‘হ্যাট হ্যাট’ করে আওয়াজ করতে থাকে।]
সুদীপা: কী হচ্ছে এসব? বাবু নেমে এসো।
[চাঁপা এই সময় ঢোকে।]
চাঁপা: ও মা ! দাদা তুমি গরু হয়েছ নাকি?
সৌমেন: আগে গাধা ছিলাম, এখন পদোন্নতি হয়ে গরু।
[তৃষার প্রবেশ]
তৃষা: মা, মা, আজ পড়তে বসবো না। আজ ছুটি চাই।
সুদীপা: সে কি?
সৌমেন: ছেড়ে দাও, একটা দিন
সুদীপা: তা বেশ, যা আজ তোদের ছুটি
রাহুল: ছুটি .. ছুটি… ছুটি …
তৃষা: কী মজা, কী মজা !
[তৃষা রাহুল বেরিয়ে যায়।]
সুদীপা: ওমা দাঁড়া দাঁড়া পরীক্ষা কেমন দিলি? [তৃষা ততক্ষণে বেরিয়ে
গেছে।]
সৌমেন: ছাড়ো তো তোমার পরীক্ষা।
চাঁপা: আমাকেও তাহলে ছুটি দাও না ! আগের লেকালটা ধরি তাহলে।
সুদীপা: যাবি যা, কাল কিন্তু দেরী করবি না ।
চাঁপা: সে তোমায় বলতে হবে না। দাদা আসি।
সৌমেন: আয় [চাঁপা বেরিয়ে যায়।] সবার যখন ছুটি, তখন আমিও তাহলে
একটু ঘুমিয়ে নিই।
সুদীপা: এখন ঘুমোবে কি? তোমায় বাজার যেতে হবে মনে নেই?
সৌমেন: কিসের বাজার?
সুদীপা: সকালে যে ফর্দ দিয়েছিলাম, ভুলে গেছো!
[সৌমেন পকেটে হাত ঢুকিয়ে খোঁজে এবং ফর্দ বেরিয়ে আসে।]
সৌমেন: ও হো [খেয়াল হয়।]
সুদীপা: ঐ ফর্দতে আর একটা জিনিস লিখে নাও – এক কিলো এরিয়েল।
সৌমেন: সর্বনাশ! এত বড় ফর্দ।
আমার প্রিয় মানুষ বিভাসদা নাটক এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। দারুণ লেগেছে।
ReplyDeleteMan Bhare Gelo
ReplyDeleteDuti natak e bhalo
ReplyDelete