শতবর্ষে সোমেন চন্দঃ বিধান রায়





ফুলবেড়িয়া থেকে ট্রেনে বিশ-বত্রিশ মাইল দূরে, শীতলাক্ষ নদীর ব্রিজ পার হয়ে ঘোড়াশাল ফ্লাগ    স্টেশন। ছয় মাইল দূরে অবস্থিত একটি গ্রাম বালিয়া। এটাই ছিল সোমেন চন্দের পৈতৃক নিবাস। কিন্তু সমেনের জন্ম হয় তাঁরই মাতামহের আদিনিবাস আগুলিয়া গ্রামে, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে। তাঁর জন্মের অল্পকাল পরেই মা মারা যান। পিতা নরেন্দ্রকুমার, ডাক্তার শরৎ কুমার বিশ্বাসের কন্যা সরযুকে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। এই সরযু চন্দ ছিলেন বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্না ও কর্তব্যপরায়না নারী। তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক সংস্রব সোমেনকে প্রভাবিত করেছিল।  

একান্নবর্তী পরিবারে মা, জ্যাঠাইমা, বাবা ও জ্যাঠামশাই প্রমুখের স্নেহ ভালবাসা সোমেনের   যৌথজীবন ভিত্তিক মনন গঠনে সহায়তা করেছিল। সোমেনের পিতা স্বদেশী যুগের আবহাওয়ায় লালিত পালিত হয়েছিলেন। বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, লোকমান্য তিলক, ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং প্রমুখের সংগ্রামী জীবনের নানাবিধ ঘটনার কথা সন্তান কে বলতেন। এই সব ঘটনার পাশাপাশি পারিবারিক সূত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংযোগ,তৎকালীন ঢাকার বিভিন্ন পাড়াইয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ সোমেনকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে। 

১৯৩৬ এ সোমেন ঢাকা বোর্ড থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পারিবারিক ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হলেও আর ডাক্তারি পড়া হয়নি। ১৯৬৮ নাগাদ সোমেন ঢাকার প্রগতি পাঠাগারের একনিষ্ঠ পাঠক থেকে সম্পাদকে পরিণত হন। এই সময় থেকেই সোমেন কমিউনিস্টদের কাছাকাছি আসতে থাকেন। সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চিনের মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষইয় তাঁকে যথেষ্ট পরিমাণে আলোড়িত করে। প্রগতি লেখক সংঘের রণেশ দাশগুপ্ত, জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, অচ্যুৎ গোস্বামী, সরলানন্দ সেন, অমৃত কুমার দত্ত প্রমুখের সঙ্গে সোমেনের যোগাযোগ বাড়ছে। এই পর্বেই যোগ দিচ্ছেন সতীশ পাকড়াশি দের রাজনৈতিক ক্লাসে। ১৯৩৯ নাগাদ সরাসরি অংশ নিচ্ছেন রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে। এই সবের মধ্য দিয়েই ১৯৪০ তে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্বে কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধ নীতির প্রচার, সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির নানান কাজে ঢাকা জেলায় বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যান। ধীরে ধীরে সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির ঢাকা জেলার অন্যতম সংগঠকে পরিণত হন।

১৯৪২ এর ৮ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক শিল্পী সম্মেলন। এই সম্মেলনকে ঘিরে ঢাকা অঞ্চলে বিপুল উন্মাদনা সঞ্চার হয়। উগ্রজাতীয়তাবাদীরা আক্রমণ নামিয়ে আনে। এই সম্মেলন উপলক্ষে রেল শ্রমিকদের একটি শোভাযাত্রা নিয়ে আসার সময় প্রকাশ্য রাজপথে ফ্যাসিস্ট সমর্থক আক্রমণকারীর দল সোমেন কে হত্যা করে। ঝরে পড়ে মানব মুক্তির সাধনায় নিবেদিত একুশ বছর ন মাসের একটি কাঁচা প্রাণ।
   
রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায় রেখেছিলেন সমান দক্ষতার স্বাক্ষর। স্থানীয়ভাবে ঢাকার কিছু পত্রিকায় লেখালেখি করলেও মাত্র সতের বছর বয়সে সোমেনের প্রথম গল্প সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। গল্পটির নাম ‘শিশু তপন’। আর যে যে পত্রিকাগুলির মাধ্যমে সাহিত্যিক সোমেনের আত্মপ্রকাশ ঘটে সেগুলি হল, ‘শান্তি’, ‘বলাকা’, ‘নবশক্তি’ ‘প্রভাতী’, ‘অগ্রদূত’, ‘বালিগঞ্জ’ প্রভৃতি পত্রিকায়। তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম গল্প হল ‘ইঁদুর’। বাংলা ছোটগল্পের ধারায় এক নুতন দৃষ্টিভঙ্গি। এই গল্পটি আই.সি.এস অশোক মিত্র ইংরাজিতে অনুবাদ করেন এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই গল্পটিকে পার্টি পত্রিকায় প্রকাশ করেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি কান্না সুখ দুঃখময় সংসারে যে একটা সুর ওঠে সেই যন্ত্রের তার টা বারবার কেটে দিয়ে যায় চতুর ইঁদুর। ইঁদুর কখনো কারো ভাল করে না। স্থিতিশীল জীবনে বিড়ম্বনা বাড়ায়। শ্রেণিবৈষম্যের সমাজে বাবার অসহিষ্ণুতা, মায়ের সহিষ্ণু মনোভঙ্গি, খিদে পেটে ছোটদের অবুঝ আবদার,আবার সুলভ ভোগ লালসা সব কিছুই আপাত স্বাভাবিক অবস্থানেই থাকে। কয়েকটি ইঁদুর সবার অলক্ষে শরীরে লুকানো রোগের মত অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে। ইঁদুরের বংশকে নিবংশ করতে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার তা নিম্নবিত্তের আয়ত্তের বাইরে। একটা ইঁদুর ধরার কল কিনে দু একটা ইঁদুর মেরেই উল্লাস প্রকাশ ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। এখানে ইঁদুর হল অলক্ষ্যের সার্বিক শোষণের প্রতীক। মাঝে মাঝে কয়েকটা শব্দ করে জানান দেয় মাত্র। আর এই ইঁদুর কূলকে বিনাশ করতে পারে নিপীড়িত জনতার সার্বিক সহযোগ। সেই পথে সুকুমার সমীপবর্তী। মুটে, মজুর, মেথর, কিষান,মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্ত সব মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ এই অত্যাচার ঠেকাতে পারে। সোমেন এই গল্পে সেই আশাই ব্যক্ত করেছেন। 

ঢাকার এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ছবি একটি নিম্নবিত্ত পরিবার কে কেন্দ্র করে সোমেন চন্দ দেখিয়েছেন তাঁর ‘দাঙ্গা’ গল্পে। বাবা মা বিভ্রান্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছোটভাই উত্তেজনাকর অশুভ চিন্তার শিকার, বড় ভাই একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। একটি দাঙ্গার বিস্তার,তার উত্তেজনা, লক্ষ্যভ্রষ্ট দিক সেই রাজনৈতিক কর্মীকে কীভাবে আলোড়িত করে তাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন সোমেন চন্দ তাঁর এই ‘দাঙ্গা’ গল্পে। শোষণ অত্যাচার যে বড় আকারে বারবার শ্রমজীবী নিপীড়িত মানুষের উপর আছড়ে পড়ে সেখান থেকে মুক্তি সম্ভব হয় শ্রমিক কৃষকের যৌথ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই বিষয়গুলি কথারূপ পেয়েছে সোমেনের ‘সংকেত’ গল্পে। ‘ক্রান্তি’ পত্রিকায় সোমেনের অন্যতম আর একটি গল্প ‘বনস্পতি’ প্রকাশিত হয়। ইতিহাসের সাক্ষী,চলমান সমাজজীবনের নির্বাক দর্শক এই বনস্পতি অর্থাৎ দুশো বছরের পুরাতন একটি বটগাছ। গল্পটির শুরু এক লম্পট জমিদার নবকিশোরের কথা দিয়ে আর গল্পটির শেষে দেখি সতিনের এক সাহসী লড়াই লড়ার কথা দিয়ে। এই ইতিহাসবোধ সোমেন অর্জন করেছিলেন তাঁর মার্কসীয় মতাদর্শ চর্চার মধ্য দিয়ে। ১৯৩৭-৩৮ এই সমইয়পর্বে মাত্র সতের বছর বয়সে সোমেন লেখেন ‘বন্যা’ উপন্যাসটি। প্রকাশিত হয় ‘বালিগঞ্জ’ পত্রিকায়। এই উপন্যাসটির প্রেক্ষাপ্ট নির্মিত হয়েছে বন্যায় আক্রান্ত একটি গ্রামকে ঘিরে। বন্যাক্রান্ত মানুষদের সাহায্যার্থে একটি রিলিফ কমিটির প্রতিনিধি হিসাবে রজত সেই গ্রামে এসেছে। তার সেবা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া, গ্রামে শিক্ষার আলো জ্বালানোর উদ্যোগ,দেশপ্রেমের শিক্ষা ইত্যাদি একজন কমিউনিস্ট ভাবধারার নায়ক কে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে মাত্র সতের বছর বয়েসে লেখা উপন্যাস সেখানে রজত চরিত্রের মাধ্যমে কিভাবে আপন বিশ্বাসকে সুঠামভাবে জুড়ে দিয়েছেন। গ্রামের এক ‘বিত্তহীন মধ্যবিত্ত’ প্রিয়নাথ চায় গ্রামে একটা স্কুল হোক,জমি চাইতে গেছে গাঁয়ের সম্ভ্রান্ত মানুষ তারক বিশ্বাসের কাছে। তার উত্তরে তারক বলেছে ‘ওরা লেখাপড়া শিখলে আমাদেরি ক্ষতি, তুমি আপনার মানুষ বলতে বাধা নেই,আমাদের অনেক কারসাজি ওরা ধরে ফেলবে।’ এই যে জনচেতনা বিস্তারে কায়েমি স্বার্থের বাধা সেই বোধ কিশোর সোমেনের চেতনায় ধরা পড়েছিল। ঢাকা যেলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সতীশ পাকরাশি্র রাজনৈতিক ক্লাসের নিয়মিত ছাত্র সোমেন তার অল্পকালের লেখা উপন্যাসের নায়ক রজত তো স্বাভাবিক ভাবে বলবেই ‘ আমরা খাবার সাজাই, খেতে পারিনে। রক্তের দুধ দিয়ে পুকুর কাটি চান করে রোমের রাণী। আমরা করি বাগান ফুল লুটে নেয় আর একজন।’


ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের হাতে নিহত গোলাপ আজ একশো বছরেও উদ্ভাসিত। আজো সেই ঔদ্ধত্যের বজ্রনিনাদ শোনা যায়। সভ্যতার চালিকা শক্তি যে ইতিহাস তাকে বিকৃত করে সমাজ সভ্যতাকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই আমাদের বেশি বেশি করে স্মরণ করা দরকার সেই বালক বীর কে।

* ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত

2 comments:

  1. ফুলবাড়িয়া /ফুলবেড়িয়া নয়।সোমেন চন্দ/সমেন নয়।
    গল্পকার সংগঠক সোমেন চন্দ কে বাংলাদেশের তৎকালীন নিখিল ভারত কংগ্রেসের গুন্ডারা।

    ReplyDelete

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com