ইতিহাস
বিষয়টি বড় বালাই। সেই ছোটবেলা থেকেই ইতিহাসের চোখ রাঙানি ক্লাসরুমগুলোকে অসহায়
করে তুলে। পাল-সেন-মোঘল-ইংরেজ ইত্যাদি নিয়ে কত যুদ্ধ,কত চক্রান্ত। আবার কত ভিন্ন ভিন্ন মত। অনেক পরে জানতে পারি,এই ইতিহাস
আসলে শুধুমাত্র অতীতমুখী ঘটনাকেই ইঙ্গিত করে না।ঘটনা-দুর্ঘটনা থেকে সরে এসে আজকের
দিনে ইতিহাস এক জ্ঞানতাত্ত্বিক বাচন-এ রূপ লাভ করেছে।এই ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ মতবাদীরা হলেন অভিজ্ঞতাবাদীরা -- যাঁঁদের কাছে ঐতিহাসিকের আধিপত্য বা কর্তৃত্বের তুলনায়
প্রাধান্য পায় তথ্যের নৈর্ব্যক্তিকতা।আবার ই.এইচ. কারের মতো ঐতিহাসিকরা ব্যক্তির
দৃষ্টিভঙ্গি বা ’পয়েন্ট অফ ভিউ’ -এর গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন। তবে তা যে কখনো
সাবজেকটিভ চর্চায় পরিণত না হয়,সে বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। ইতিহাস চর্চায় এই দুটো মতের
গুরুত্ব রয়েছে – একদিকে নৈর্ব্যক্তিকতা অন্যদিকে ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ।
তবে এ ব্যাপারে ইতিহাস চর্চায় একটি অন্যতম ভূমিকা নিয়েছে অবিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন নামে
দেরিদীয় মতবাদটি। টেরি ঈগেলটন এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন “Reading the Text against itself” । এটা আসলে
পোস্ট-স্ট্রাকচালিস্ট বা উত্তর-গঠনবাদী চিন্তন ,যার একটি অন্যতম বক্তব্যঃ “ they look for shifts and breaks of various kinds in the text and see
these as evidence of what is repressed or glossed over or passed over in
silence by the text” (Barry,71)। তাঁঁরা আসলে কোন স্থির ঐতিহাসিক সত্যে বিশ্বাস না
রেখে,একটি টেক্সট বা রচনার নানারকম অসংহতি,অসঙ্গতি, ফাঁকফোকর বা স্ববিরোধিতাকে চিহ্নিত করতে লাগলেন। একটি পাঠের নানারকম বিকল্প পাঠের সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে
চাইলেন। “ অবিনির্মাণ বা deconstruction একটা টেক্সট -এর আপাত
নির্দিষ্ট সুসংহত অর্থকে ভেঙে ভেঙে দেখায় তার মধ্যে অন্যতর অর্থের –অন্যতর
ইতিহাসের –কত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে ......” ( চক্রবর্তী,৩৬) ।এই ভাবনা থেকে
স্পষ্ট,ইতিহাস বিষয়টি নানা রঙের রামধনু।এর কোনো একক,নির্বিকল্প পাঠ পাওয়া
অসম্ভব।তাই ইতিহাসের ভাষ্যকে নতুন করে দেখাও ইতিহাসের অঙ্গ । রচিত হয় ইতিহাসের ইতিহাস -- যা ইংরেজিতে ‘Historiography’ বলে পরিচিত।
পেশায় ইংরেজির অধ্যাপক ড. কল্যাণ চ্যাটার্জীর
“সাহেবদের পুরুলিয়া ও মানভূম” নামক বইটিতে এমনই এক বিস্মৃত ইতিহাসের ইতিহাস পাঠকের
সামনে তুলে ধরা হয়েছে। নাম থেকেই স্পষ্ট, এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি তথাকথিত
পিছিয়ে থাকা জেলা পুরুলিয়া সম্পর্কিত বই। মানভূম তার আদি নাম। সাহেবদের উল্লেখ আরও
বুঝিয়ে দেয়,পুরুলিয়া তথা মানভূম নিয়ে এই চর্চা
ঔপনিবেশিক আমলের। তবে এই বইটি ঔপনিবেশিক আমলের পুরুলিয়া বা মানভূমের কোনো
ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত নয়। সাহেবদের লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধে পুরুলিয়া বা
মানভূম সম্পর্কে যে ইতিবৃত্ত নথিবদ্ধ রয়েছে,তারই এক ভাষ্য এই ঔপনিবেশিকোত্তর সময়ে
তিনি অবিনির্মাণ করেছেন।সাহেবদের যে গ্রন্থগুলির তিনি সাহায্য নিয়েছেন সেগুলি হল -- জেনারেল এডওয়ার্ড টুইট ডাল্টন-এর “ডেসক্রেপ্টিভ এথনোগ্রাফি অফ বেঙ্গল”(১৮৭২),
ডাবলিউ এইচ হান্টারের “স্ট্যাটিসটিকাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল”(১৮৭৭),ভ্যালেন্টাইন
বল এর এশিয়াটিক জার্নালে প্রকাশিত “ফ্লোরা অফ মানভূম’ এবং “আভি-ফণা অফ মানভূম’
দুটি প্রবন্ধ ছাড়াও “জঙ্গল লাইফ অফ ইন্ডিয়া’, এইচ. কুপল্যান্ডের ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক
গ্যাজেটিয়ারঃমানভূম’(১৯১১), জন অর্ডেন এর “ দি ছৌ ডান্সারস অফ পুরুলিয়া’(১৯৭১), জে.ডি.
ব্যাগলার এর “রিপোর্ট অফ এ টুর থ্রু দা বেঙ্গল’’(১৯৬৬)।
এই গ্রন্থটি
পড়তে গিয়ে ‘ভূমিকাঃযা না জানলেও চলে’ বলে যে অধ্যায়টি রয়েছে তা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ । লেখক ড. চ্যাটার্জী কোন প্রেক্ষিত ও ইতিহাসের পরিভাষায় কোন ‘পয়েন্ট
অফ ভিউ’ বা বিশেষ কোন ঐতিহাসিক দর্শন থেকে
লিখেছেন তা বোঝা যাবে।তিনি বলেনঃ “প্রাথমিকভাবে পুরুলিয়া জেলার ঔপনিবেশিক পর্যায়ের
ইতিহাস জানায় ছিল উদ্দেশ্য।অপরিচিত ইউরোপিয়ানের চোখ দিয়ে আমার জেলা কেমন তা জানা
ছিল আগ্রহের মূল।মনে প্রশ্ন ছিল পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক,ঊষর এই প্রদেশ কি তখনও একই
রকম উপেক্ষিত ও গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হত......... দারিদ্র-পীড়িত,শিক্ষার
আলোক-বঞ্চিত,রোদপড়া,শীর্ণ চেহারার মানুষগুলিকে কী দৃষ্টিতে দেখেছিলেন সাহেবরা?
...... এছাড়া হয়তো সাহেবদের লেখায় খুঁজতে চেয়েছিলাম ঔপনিবেশিকের মনস্তত্ব।”
(চ্যাটার্জী,১৫) সেই হিসাবে তিনি পোস্টকলোনিয়াল-প্রাচ্যতাত্ত্বিক চিন্তনে ও মিশেল
ফুকো-জাত জ্ঞান-ক্ষমতা ডিসকোর্স দিয়ে সাহেবদের সাম্রাজ্যবাদী কুটিল মনটিকে যেমন
সনাক্ত করতে চেয়েছেন তেমনি ক্ষমতার বিপরীত মেরুতে থাকা শোষিত এই পুরুলিয়ার ছবি
তিনি পাঠকদের দিতে চেয়েছেন। এখানেই থামা যেত। তিনি একরৈখিক ভাবনা দ্বারা এর ভাষ্য নির্মাণ না করে সেই
ধুলোপড়া সাদা-কালো সম্পর্ক পড়তে গিয়ে তিনি অভিভূত হন। আলি বেহদাদের’বিলেটেড ট্র্যাভেলারস” তাকে অন্যভাবে
অনুপ্রাণিত করে। সাঈদের ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যতাত্ত্বিক ভাবনায় আটকে না থেকে
তিনি বলেনঃ “এই ডিসকোর্সকে নির্দ্বিধায় উপনিবেশকারীর সংকীর্ণ স্বার্থের রক্ষাকবচ
বলে খারিজ করে দেওয়া যায় না।দিলে ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়। সম্ভাবনা থেকে যায়
মূল্যবান তথ্য হারাবার।” তথ্যের নথিবদ্ধকরণে তাদের নৈর্ব্যক্তিকতা,ইতিহাসের টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে
রচিত এক বিস্মৃত অতীত কীভাবে কলোনিয়ান হেজিমনি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন পথযাত্রার
আহ্বান জানায় তার ও এক নির্দেশক এই বই।
এই গ্রন্থটি
বিভক্ত হয়েছে ভূমিকা সহ মোট সাতটি অধ্যায়ে। এই অধ্যায়গুলি হলঃ মুলুক তালুক শহর
গ্রাম, লোকজন, খাওয়া-দাওয়া চাষবাস, রীতিনীতি দেশাচার, মন্বন্তর,সাহেবনামা। সপ্ত অধ্যায়ে বিভাজিত এই বইটির মধ্যে পুরুলিয়ার যে সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায় তা একদিকে ঔপনিবেশিক সাহেবদের
হাতে নির্মিত ‘অপর’দের কথা তেমনি ‘অপর’দের স্বকীয়তা কোথায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে তারও
বিবরণ লক্ষিত হয়। প্রথম অধ্যায় মুলুক তালুক শহর গ্রাম’ এ পুরুলিয়ার তথা মানভূমের
ইতিহাসহীনতার কথা দিয়ে শুরু হয়েছে। কুপল্যান্ড সাহেব জানাচ্ছেন নাম গোত্রহীন
অকুলীন এই পুরুলিয়ার এই অঞ্চলটির প্রাচীন ইতিহাসের কোনো রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে না।বেগলার সাহেব তাঁর পুস্তকে এই
অঞ্চলে নানা রকম জৈন মন্দির দেখে কোন সুমহান সভ্যতা এখানে ছিল বলে তিনি মনে করেন । ডালটন সাহেব মনে করেছেন সেই সভ্যতা হয়তোবা ভূমিজদের হাতে
ধ্বংস হয়ে যায়। কুপল্যান্ড সাহেব ভবিষ্যত পুরাণের রেফারেন্সে এই অঞ্চলটিকে
‘বন্য,পেশায় ডাকাত রাজপুতদের বাস বলে মনে করেন’ অর্থাৎ সভ্য মানুষের পক্ষে
বাসযোগ্য ছিল না বলে মনে করেন। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানী লাভের পর সাহেবদের হাতেই তার
ইতিহাসের জন্ম হয়। যদিও তাঃ “ইতিহাস শাসকের হাতে নির্মিত।স্বাভাবিকভাবে এই নির্মাণ
বরাবর শাসকের নানান বাধ্য-বাধ্যকতা, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার আওতাধীন। এই নির্মাণের
যৌক্তিককাঠামো,অসম্পুর্ণতা বা এমনকি বিকৃতির রূপ কেমন তা পরবর্তী পাঠগুলিতে পাঠকের
খানিক চোখে পড়তেও পারে”(চ্যাটার্জী,২৫) ছোটনাগপুর থেকে কীভবে পুরুলিয়া বা মানভূম
জন্ম হল তার ইতিহাস বিধৃত রয়েছে এখানে। এখানকার লোকজন বলতে মূলত সাহেবদের দেখা এখানকার
গরিব মানুষ, চূয়াড়, খেড়িয়া, সরাক দের কথা বলেছেন। চিড়ে, মুড়ি খই ইত্যাদি নানা রকম
খাবার উঠে এসেছে এই কৃষিপ্রধান অঞ্চলটিতে। নরবলি, ডাইনি, ছৌ নিয়ে পুরুলিয় সংস্কৃতি
নিয়ে সাহেবদের ভাষ্য তিনি তুলেধরেছেন।
১৮৬৫ সালে মানভূমে কীভাবে সাহেবরা দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে এখানকার মানুষের সঙ্গে
ব্যবহার করেছিল, তারও অমানবিক ছবি দেখতে পাওয়া যায়। সাহেবনামাতে যে সব সাহেবদের বই
উল্লেখ করা হয়েছে সেই সব সাহেবদের পরিচয় দেওয়া আছে।
সবশেষে বলা
যায়, এই গ্রন্থটি আসলে এক ইতিহাসের ইতিহাস।যেখানে ঔপনিবেশিক ভাষ্যকে তিনি অবিনির্মাণ
বা deconstruction করে একটি বিকল্প বাচনকে
খুঁজতে চেয়েছেন। সেই বাচনে তাঁর নিজ যাপিত কাল এবং একটি বিশেষ কালের ঐতিহাসিক
দর্শন ফুটে উঠেছে। যে কোনো পাঠক এই বইটি পড়ে খুঁজে নিতে পারবে এই সময়ের
চেতনাকে কিংবা এই বইটি অনুপ্রাণিত করবে
সাহেবদের ইতিবাসকে অবিনির্মাণের যে কৌশল তা জানতে। ভারহীন স্পষ্ট গদ্যে লেখা এই
বইটি পাঠককে আনন্দ দেবে আশা করি।
তথ্যসূত্রঃ
১. Barry Peter Beginning Theory, Viva Book, Kolkata, 2011
২. চক্রবর্তী, রাজকুমার, ইতিহাসচর্চা
নির্মাণ অবিনির্মাণ বিকৃতি, এবং মুশায়েরা,কলকাতা,২০১০
৩. চ্যাটার্জী, কল্যাণ, সাহেবদের
পুরুলিয়া ও মানভূম, নাটমন্দির,পুরুলিয়া, ২০১৯
সাহেবদের পুরুলিয়া ও মানভূম: কল্যাণ চ্যাটার্জী
প্রচ্ছদ: জিশান
রায়
প্রকাশক: নাটমন্দির, পুরুলিয়া: ১২৫ টাকা (প্রথম প্রকাশঃ মার্চ
২০১৯)
প্রচ্ছদ: জিশান রায়
প্রকাশক: নাটমন্দির, পুরুলিয়া: ১২৫ টাকা (প্রথম প্রকাশঃ মার্চ ২০১৯)
baiti parar ichhe railo
ReplyDelete