যখন মাঝ রাত
আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল সুমিতের। চোখে কোনও ঘোর
লেগে নেই তার। ঘুম থেকে একেবারে হঠাৎই সম্বিতে ফিরে এল সে। এর মাঝে কোনও গোধূলি নেই।
ফ্যানের হাওয়ার তোড়ের মধ্যেই কার যেন একটা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে না? ঘুমের চাদর সরিয়ে
ওই আওয়াজটা বেশ কয়েক বার কানে ঢুকেছে তার। একটানা নয়, কিন্তু, শব্দটার একটা তাল আছে।
২/৩ সেকেন্ড ধরে খানিকক্ষণ অন্তর অন্তর হচ্ছিল আওয়াজটা। কিন্তু, কই, সে ঘুম থেকে ওঠার
পর এখন তো আর হচ্ছে না? রাত কত হল এখন? পাশে অঙ্কিতা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। মাঝে মাঝে নাকও
ডাকছে। ওপাশে মেয়েটাও। রাত কত হল এখন? মোবাইলটা টুক করে জ্বালল সুমিত। এখন ১.৪৫ বাজে।
পর দিন অন্তত ৪০ মিনিট আগে ঘুম ভাঙল সুমিতের।
বাড়তি সময়টা একটু বাইরে থেকে ঘুরে এল সে। দোকানে চা খেল। তার পর বাড়ি ফিরে স্নানের
জন্য বাথরুমে ঢুকল। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা টের পেল সুমিত। মাথার মধ্যে গোঙানির
শব্দটা যেন গেঁথে গেছে। একলা হলেই একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর হানা দিচ্ছে আওয়াজটা।
একটা চাপা গোঙানি। শব্দটা মাথার মধ্যেই খুব ক্ষীণ হয়ে মিশে রয়েছে। অথচ খুব তীক্ষ্ণ।
ব্যাপারটাকে আর বেশি আমল দিল না সুমিত। খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়ল অফিসে। সে দিন রাতেও তার
ঘুমটা একই ভাবে ভেঙে গেল। আবার একই আওয়াজ। মৃদু অথচ তীক্ষ্ম। ঘুমের মধ্যে শব্দটা পৌঁছচ্ছে
তার মস্তিষ্কে। কিন্তু, ঘুম ভাঙলেই আর নেই। কীসের শব্দ ওটা? বেশ গরম লাগছে তার। একটা
সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল সুমিতের। দপ করে তার মাথায় এল, আচ্ছা, এখন বাজে কটা? মোবাইলটা
জ্বেলে সুমিত দেখল রাত ১.৪৫।
পর পর দু'দিন একই ঘটনা। একই সময়। বাড়িতে কিছু
না বললেও এই দুটো মিল তাকে, খানিকটা ভাবিয়ে তুলল। সারা দিন অফিসের কাজ, ট্রেনের সহযাত্রীদের
সঙ্গে কাটিয়ে ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সুমিত। কিন্তু, স্টেশনে নেমে বাড়ির যত
কাছে আসতে থাকল ততই যেন শব্দটা ঘিরে ধরতে থাকল তাকে। কার গোঙানি ওটা? সন্ধে থেকেই তার
মাথায় ভর করে বসল চিন্তাটা। খাওয়ার সময় অঙ্কিতার সঙ্গে গল্প করতে করতে ব্যাপারটা ভুলেই
গিয়েছিল সুমিত। কিন্তু, বিছানার দিকে পা বাড়াতেই ফের ভাবনাটা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
ধরল। আজ আবার তেমন হবে না তো?
সে রাতে স্বপ্ন দেখল সুমিত৷ ট্রেনে চড়ে কোথায়
একটা যাচ্ছে। কামরায় তার আশপাশের মানুষের কোমর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বাকিটা ঘন অন্ধকারে
ডুবে। তার নিজেরও তেমন অবস্থা কিনা সেটা দেখতে গেল সুমিত। হঠাৎ তার নজরে এল, সে উলঙ্গ।
মনে একটা তীব্র আতঙ্ক তৈরি হল। ট্রেনের যাত্রীদের সকলের মুখগুলো যেন হঠাৎই চৌকো হয়ে
যেতে থাকল। একটা মজা পুকুরের পাঁকে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে একটা ক্লাস থ্রি-ফোরের ছেলে ঘুরে
বেড়াচ্ছে৷ মা কালী এসে তাকে বলছে, ''আমাকে ধরতো দেখি?'' ঘরের কোথাও যেন একটা বিরাট
আয়না লুকোন রয়েছে। তাতে যেন তার সব নড়াচড়া ধরা পড়ছে। কেউ যেন লুকিয়ে লুকিয়ে তার উপর
নজর রাখছে।
ঘুমটা ভেঙে গেল সুমিতের৷ তখন অবশ্য ভোর হয়ে গেছে।
রাত ১.৪৫-এ তার ঘুম ভাঙেনি বটে, কিন্তু, সে রাতেও সে শব্দটা শুনেছে। তার কানে ঢুকেছে
ওই গোঙানির আওয়াজ। অফিসে যাওয়ার পথেই অংশুমানকে ফোন করল সুমিত। সাইক্রিয়াটিস্ট অংশুমান
দত্তগুপ্ত। সুমিতের বন্ধু বটে। তবে তাকে খোলাখুলি এই সমস্যাটা এখনই বলা যাবে না। একটু
অন্যের নামে চালাতে হবে। হাই হ্যালোর পর আসল কথাটা পেড়েই ফেলল সুমিত। ''অংশুমান, ঘুমের
মধ্যে কী আওয়াজ শুনতে পায় মানুষ? এমন কি কোনও সমস্যা তোদের ডাক্তারির কেতাবে লেখে?
আমার পাড়ার একটি ছেলে এমন সমস্যায় পড়েছে।'' ওপার থেকে অংশুমান বলল, "হ্যাঁ, এমনটা
হয়। যারা খুব ভয় পায়, মানে ভিতু প্রকৃতির তাদের এমন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটাকে ফ্যাসমোফোবিয়া
বলে। মনে হয়, এই বুঝি কেউ কথা বলল। কোনও আওয়াজ করল। কখনও মনে হয়, ঘরে আয়না রাখা। এসব
আর কী। কাউন্সেলিং হলে এ সব কাটানো কোনও ব্যাপারই নয়। ছেলেটাকে আমার চেম্বারে নিয়ে
আসতে বল না?" অংশুমানের থেকে ব্যাপারটা জানার পর মনে মনে বেশ শান্তি পেল সুমিত।
যাক ব্যাপারটা তাহলে ততটা মারাত্মক কিছু নয়। ইয়ার এন্ডিংয়ের সময় এখন। এ ক'দিন অফিসে
যা চাপ যাচ্ছে টার্গেট অ্যাচিভ করার ভয়টা যে তাকে ভিতরে ভিতরে তাড়া করছে সেটা সে ভালই
জানে। যাক গে, অংশুমানের থেকে সমস্যাটার একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পেয়ে তার মনটা
ভাল হয়ে গেল। ওফ, স্বস্তি!
সে রাতেও
ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল সুমিতের। ঘরে সেই গোঙানিটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ভেসে আসছে
না? সে চোখ খুললেও কিন্তু, এ বার আর শব্দটা থামেনি। হঠাৎ তার মাথায় এল, আচ্ছা, এখন
কটা বাজে? মোবাইল জ্বালতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য নজরে এল তার। অঙ্কিতা ঘুমের মধ্যেই বিড়
বিড় করে কার সঙ্গে কথা বলে চলেছে৷ "ওফ মা! এখন চুপ করো। সবাই ঘুমোচ্ছে, জেগে যাবে।
আমাকেও ঘুমোতে দাও। যা করার কাল দুপুরে করব।" আচমকা ঘুম থেকে উঠলেও সুমিতের ভালই
মনে পড়ছে, অঙ্কিতার মা মারা গিয়েছে মাস ছ'য়েক আগে। গলার ক্যানসারে ভুগে। শেষ দিকে কথা
বেরোত না, স্রেফ ওই মৃদু অথচ তীক্ষ্ম গোঙানি।
No comments:
Post a Comment