কালো বাঁশি...
যখন
জন্মালাম তার বহুবছর আগেই
ঠাকুরদা আউট অব ওয়ার্ল্ড।
বাবার বয়সই তখন নয়
কি দশ। আমার ঠাকুরদা
তারাপদ মুখোপাধ্যায়।
ঠাকুমা ছিলেন ঠাকুরদার সেকেন্ড ওয়াইফ। ঠাকুমার কাছে গল্পে শোনা
ঠাকুরদার যাত্রার দল ছিলো। অভিনেতা
ছিলেন না ঠাকুরদা। যাত্রার
সুর পার্টির নেতা ছিলেন। কালো
বাঁশি বাজাতেন।
কালো
বাঁশি...
এ গ্রাম সে গ্রামে দল
নিয়ে গাইতেন পালা...লাভ বলতে গুড়
বেচে হাঁড়ি লাভ। তাই চাষের
জমি বিক্রির পর বিক্রি। তাতেই
চলতো সংসার..। ঠাকুমার বাপের
বাড়ি পাশের গ্রামেই। সেখান থেকেও আসতো চাল, ডাল,
পরনের কাপড়। বাবারা তিন ভাই এক
বোন। সংসারী বলতে যা বোঝায়
তারাপদর ডিকশনারি তে ছিলোই না
সে শব্দ। দল আর পালাগানই
ছিলো তার নিত্যপুজা...দেবতা
ছিলো তার কাঠের কালো
বাঁশি।
কালো
বাঁশি...........
তিন
ছেলে আর এক মেয়ে
নিয়ে ঠাকুমা সংসারের সীমান্ত প্রহরী হয়ে গাইতেন জীবনের
জয়গাথা। এদিকে তারাপদর মনের কালো বাঁশি
সাপুড়ের রুপ ধরে....
প্রদীপ
কুমারের " নাগীন" হয়ে " মন ডোলে তেরা
তন ডোলে রে..." র
সুপার স্টার থেকে মেগা স্টার
হবার আগেই সময়ের বহু
আগেই যায় থেমে...সাপূড়ের
সুর।
আমার
বাবা তখন বছর আটেকের
পুড়ে
যায় তারাপদ শরীর। রেখে যায় কালো
বাঁশি ।
কালো
বাঁশি......
শুরু
হয় ঠাকুমার জীবন যুদ্ধের নয়া
ইতিহাস। যুদ্ধ.. যুদ্ধ.. আর যুদ্ধের পর
কালো বাঁশি হাত বদল হয়ে
বাবার কাস্টডিতে আসে...তবে এবার অভিনেতা
হয়ে যাত্রার....কালো বাঁশির সুর
উঠে আসে গলায়।
আসরের
পর আসর রঙিন হয়
তারাপদর ছেলের গানে.......
গাঁয়ের
একচালা মিউজিয়ামেই থেকে যায় কালো
বাঁশি ।
কালো
বাঁশি......
কালো
বাঁশি....বাজাতো মেদিনীপুরের সবুর আলি.. অঘ্রাণের
সকাল বেলার কচি ধানের শাদা
দুধের মতো মোলায়েম ছিলো
তার সুর...সুরে উঠে আসতো
দেশভাগ....রক্ত....ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের লাশ...মায়ের ছেঁড়া শাড়ি...যুবতীর বিধস্ত স্তন... নবীন কিশোরের পুড়ে
যাওয়া শরীর।
সবুর
আলি যতবার বাজাতো তার কালো বাঁশি,
ঝরনার মতো ঝড়ে পড়তো
তার চোখের জল। সে শুধুই
চোখের জল তো নয়
একটা
ইতিহাস....একটুকরো.... এলোমেলো....অবিন্যস্ত। সাজিয়ে নেওয়া ইতিহাস লজ্জা পেত। নদীর
জলে
ভেলা ভাসানো বেহুলারা যেমন করে লখিন্দর
আনতে যায় তেমন করে
ইতিহাস বয়ে আনে সবুরের
কালো বাঁশি ।
কালো
বাঁশি....
তারাপদ...তারাপদর ছেলে... সবুর আলি...রঙ
মেখে উঠে পড়ে মঞ্চে.....পরিচালক কালো চশমা পরিয়ে
দেয় সবুর আলির চোখে।
চোখে কালো রঙ। কালো
চশমায় সুর হাতরায় সবুর....অবাক দুচোখ...তারাপদ
এগিয়ে এসে বলে...
বাজা
সবুর, বাজা...তোর কালো বাঁশি
।
সবুর
ফুঁ দেয় বাঁশিতে, ফুঁ
দেয়, বাজে কই? বাজে
না তো...কোন শব্দই
উঠে আসেনা.. নিশ্চুপ কালো বাঁশি ।
কালো
বাঁশি....
সবুর
কাঁদে। তারাপদ হাসে। পরিচালক জালের আড়ালে।
এ কোন বিশ্বাসহীনতার জালে
জড়ালে আমায়?
সবুর
চিৎকার করে বলে ওঠে.....
পরিচালক
জালের আড়াল থেকে মুচকি
হাসে.....
মায়াজড়ানো
মোহে সবুর পরিচালকের দিকে
তাকায়
সংলাপ
বলে.......বেহুলার ভেলা ভাসানো নদীর
তীরে এসে তারাপদর দিকে
তাকায়.... তারাপদ ভেলায় ভেসে চলে যায়.....
চলে যায়.... চলে যায় ওপারে...সেখানে সবার চোখে কালো
চশমা....তারাপদ ভূলে যায় পথ।
পা যায় আটকে। পারে
না হাঁটতে.... হাতে নেই কালো
বাঁশি......
ভানদিকে
বামদিকে কালো চশমা.............
এখানে
এখন হলুদ ভোর। হলুদ
সকাল। বিকেল হলুদ। হলুদ রাত। হলুদ
রঙের বাঁশি ।
ঐ তো সবুর আলি
হাঁটছে হলুদ পিচের রাস্তায়.....
সবুর...
সবুর... সবুর..... হাঁক মারে তারাপদ।
তারাপদ
দিকে লোকটা তাকায়। সবুর তো নয়
সে। হলুদ বাঁশিতে ফুঁ
দেয় লোকটা। চেনা চেনা লাগে
সে সুর।
এতো
মেকি কেন এ সুর?
কর্কশ,
তালকাটা,ছন্দ নেই। নেই
মোহ। নেই তো চেনা
যন্ত্রনা.... চেনা আনন্দ।
কে ঐ লোকটা?
ঠিক
সবুরের মতো দেখতে?
কে?
কে?
এ কোথায় এলো তারাপদ?
এ কোন শহর? হলুদ
জঙ্গল চারপাশে। হলুদ হলুদ মানুষ।
মানুষগুলোর হাতে একটা করে
বাঁশি । সব হলুদ। চোখে
কালো চশমা সবার।
কোথায়
আমার গ্রামের আটচালা? যেখানে ছুটতো আমার কালো বাঁশি
ঘোড়ার মতো?
কোথায়
কালো বাঁশিওয়ালা সবুর? তারাপদ খুঁজতে খুঁজতে একটা হলুদ পাহাড়ের
নীচে এসে দাঁড়ায়......
হাসি
পায়....ভাবে শহরের বুকের
মধ্যে পাহাড়? পাহাড়ের গায়ে হলুদ হলুদ
শরীরের মানুষের হাতে হলুদ রঙের
বাঁশি বেজেই চলেছে। এক অদ্ভুত সুরে
কথা বলে বাঁশিরা। পাহাড়
চিরে চলে গেছে যে
সরু পথ সে পথ
বেয়ে এগিয়ে যায়... উঁচুতে উঠতে থাকে... আরো
আরো উঁচুতে আরো আরো উঁচু
তে.....পা ধরে আসে....পাহাড়ের উঁচু নীচু পথে
পা রক্তে ভরে যায়। পথ
লাল হয়ে যায়.....এবার
পাহাড়ের মাথায়.... তাকায় নীচে.... ঐতো সবুর আলি....
চিৎকার করে ডাকে.... সবুর....
সবুর
হাঁটছে
সবুর কালো বাঁশি হাতে.....
পাশে তারাপদর ছেলে...হাঁটছে সবুরের হাত ধরে...
তারাপদর
চিৎকারের শব্দ বাড়ে...... কেউ
শুনতে পায় না। না
সবুর। না তারাপদর ছেলে।
কালো বাঁশিটা হাত বদল করে...এক হাত থেকে
দুহাত.... দুহাত থেকে তিন হাত.......
চার.. পাঁচ....
পাঁচশো... পাঁচহাজার.... পাঁচ...
তারাপদ
ঝাঁপ দেয় পাহাড়ের মাথা
থেকে নীচে...... মৃত্যু অনিবার্য সে জানে। তবু
ধরবেই একবার কালো বাঁশিটাকে। ধরবেই।
মরন হয় তো হোক।
একবার বুক ভরে শ্বাস
নিয়ে দেবেই কালো বাঁশির মনের
গর্তে ফুঁ। শূন্যে তারাপদ।
নীচে পড়বে এবার......।
শহরের গভীর কালো রাস্তায়
শরীর আছড়ে পরবে। রক্তে
মাখামাখি হবে তারাপদর শরীর.....চোখ বন্ধ তারাপদর।
হঠাৎ
চোখ খুলে দেখে..... সবুর,
তারাপদর ছেলের বাহুর জালে আটকে তারাপদ।
কালো বাঁশি হাতে সবুর।

কাঁধে
তুলে নেয় তারা। এবার
তৈরী। ছুঁড়ে দেয়....... এক হাত থেকে
দুহাত... দুহাত থেকে তিন হাত...চার.....পাঁচ....পাঁচশো...
পাঁচ
হাজার.... পাঁচ.........সুর ধেয়ে যায়
এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম....
সে শহর থেকে অন্য
শহর....নদী থেকে পাহাড়...
পাহাড় থেকে সমুদ্র......জনপদের
সমুখে জলপাই রঙে পোষাকে... তারাপদ....
তারাপদর ছেলে.... আর সবুর আলি...
তাদের সবার হাতে বাঁশি...
কালো
বাঁশি...
Chaluk Lekha
ReplyDeleteKhub Sundar...aaro Kahini chai
ReplyDelete